ঢাবিতে এক্সিকিউটিভ এমবিএ করছেন ট্রান্সজেন্ডার অংকিতা

অংকিতা ইসলাম মেধার ভিত্তিতে ঢাবিতে এক্সিকিউটিভ এমবিএতে ভর্তি হয়েছেন
 ছবি: সংগৃহীত

ভর্তি পরীক্ষার প্রবেশপত্রে নাম লেখা ‘জাহিদুল ইসলাম’। তবে তিনি নিজের পরিচয় দিলেন ‘অংকিতা ইসলাম’ নামে। তিনি একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ব্যবস্থাপনা বিভাগে এক্সিকিউটিভ এমবিএ করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।

অংকিতা বলেন, ‘ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধার ভিত্তিতে ঢাবিতে এক্সিকিউটিভ এমবিএ করার সুযোগ পেয়েছি। ইতিমধ্যে ভর্তিও হয়েছি।’

ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য অংকিতাকে ফরম পূরণ করতে হয়েছিল। অংকিতা জানান, ফরমে জেন্ডারের জায়গায় ‘নারী’, ‘পুরুষ’ ও ‘অন্যান্য’ বিকল্প ছিল। তিনি ‘অন্যান্য’ বিকল্পটি বেছে নেন।

গত ২ ডিসেম্বর ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন অংকিতা। লিখিত পরীক্ষায় টিকে অংশ নেন মৌখিক পরীক্ষায়। মৌখিক পরীক্ষায়ও তিনি সফল হন। অংকিতা বলেন, মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডের সবাই তাঁর ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের সঙ্গে অংকিতা ইসলাম ও হো চি মিন ইসলাম

চূড়ান্ত ফলাফলে মেধাতালিকায় ১৮৩তম হন অংকিতা। পরে তিনি ১২ হাজার টাকা ফি দিয়ে ভর্তি হন।

অংকিতা বলেন, এক্সিকিউটিভ এমবিএ করার মোট খরচ দেখে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। পরে গত রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। তুলে ধরেন নিজের আর্থিক অবস্থার কথা। তখন উপাচার্য নিজ উদ্যোগে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিনের সঙ্গে কথা বলেন। বিভিন্ন ফি মওকুফ করে দেওয়ার আশ্বাস দেন। এই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এ পদক্ষেপের জন্য উপাচার্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।

অংকিতা বর্তমানে রাজধানীর একটি বেসরকারি ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগে কর্মরত। এক বছরের বেশি সময় তিনি চাকরি করছেন। কিন্তু তাঁর যে বেতন, তা দিয়ে এক্সিকিউটিভ এমবিএর খরচ চালানো অসম্ভব। তিনি বলেন, ‘টাকার জন্য কারও কাছে হাত পাততে লজ্জা লাগছিল। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় টিকে যাওয়ার পর বেতন থেকে ১২ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হই। এমন পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসেন ট্রান্সজেন্ডার অধিকারকর্মী হো চি মিন ইসলাম। তাঁর সাহায্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করি।’

হো চি মিন ইসলাম গত সোমবার এক ফেসবুক পোস্টে ঢাবি উপাচার্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি লিখেছেন, ‘অংকিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়তে যাচ্ছে। পরীক্ষা দিয়েছে, চান্স পেয়েছে। অনলাইনে ভর্তি ফি পরিশোধ করে ভর্তি হয়েছে। এরপরও ওর এমবিএ করা নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। কারণ, এ দেশে কোয়ালিটি এডুকেশন ও উচ্চশিক্ষা শুধু তাঁদের জন্যই সহজ, যাঁদের ব্যাংকে বা ঘরের আলমারিতে টাকা গোছানো আছে। অংকিতা তো একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী, ওর পক্ষে তো চার গুণ কঠিন উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা।’

ট্রান্সজেন্ডার হো চি মিন ইসলাম বর্তমানে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করার আগে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা। কিন্তু কোথাও থেকে সহায়তার আশ্বাস পাচ্ছিলেন না। পরে উপাচার্যের কাছে সময় চাইলে তিনি সরাসরি দেখা করতে বলেন। শেষ পর্যন্ত তিনিই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন।

প্রথম আলো কার্যালয়ে অংকিতা ইসলাম

হো চি মিন ইসলাম বলেন, আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে ট্রান্সজেন্ডারদের ব্যাপারে সমাজে একধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এটা ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির জন্য একটা বড় অর্জন।

অংকিতা বড় হয়েছেন টাঙ্গাইলে। একসময় তিনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। তবে এখন ধীরে ধীরে পরিবার তাঁকে মেনে নিচ্ছে।

২০২১ সালে ঢাকায় আসেন অংকিতা। গত বছর তিনি অংকিতা পরিচয়ে বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছেন। কিছুদিন আগে তাঁর মা ও ভাই ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে তিনি ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। এ ছবি তিনি ফেসবুকেও দিয়েছেন।

অংকিতা বলেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁকে নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে। শিকার হয়েছেন নির্যাতনের। জাহিদুল ইসলাম থেকে অংকিতা ইসলাম হতে গিয়ে অন্য ট্রান্সজেন্ডারদের মতো তাঁকেও শতসহস্র চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে।

অংকিতা বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে অনার্স করেছেন। তারপর চাকরি শুরু করায় পড়াশোনায় বিরতি দিতে হয়। এখন তিনি দিনে চাকরি করে সন্ধ্যায় এমবিএ করবেন। এতে কোনো সমস্যা হবে না বলেই মনে করেন তিনি।

সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী নিজের যোগ্যতায় এক্সিকিউটিভ এমবিএ করার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর পড়াশোনা যাতে অব্যাহত থাকে, তা দেখার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। ডিনকে অনুরোধ করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফি মওকুফ করে এই ট্রান্সজেন্ডার নারীকে যেন সার্বিক সহযোগিতা করা হয়। সেভাবেই প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে।

আখতারুজ্জামান বলেন, সব মানুষের মর্যাদা ও স্বীকৃতি দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাইকে ধারণ করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ ব্যাপারে সচেষ্ট রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখে অন্য প্রতিষ্ঠানও এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াবে বলে তিনি আশাবাদী। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) মূল কথাই হলো কাউকে পিছিয়ে রাখা যাবে না। তাই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পাশে সবাইকে দাঁড়াতে হবে।

আখতারুজ্জামান আরও বলেন, ‘দুজন ট্রান্সজেন্ডার নারী যেভাবে নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করলেন, কথা বললেন, অধিকারের কথা তুলে ধরলেন, এমন নজির আমি আগে আমার জীবনে দেখিনি। এই মানুষগুলো অনেক কষ্ট করে এ পর্যায়ে এসেছেন। এখন তাঁদের অগ্রযাত্রায় সহায়তার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে।’