বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, দেশের পিছিয়ে পড়া বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার সুরক্ষায় আলাদা একটি সংস্কার কমিশন গঠন করতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার। এটা সরকার করতে পারলেই ভালো। তবে তা যদি সম্ভব না হয় তবে এসব জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং নাগরিক সমাজ মিলে এমন একটি কমিশন গঠন করতে পারেন। আর সেই কমিশনের উচিত তাদের প্রস্তাবগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তুলে ধরা।
‘বৈষম্যের অবসান হোক, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অংশীদারিত্ব উদ্যাপন’ এক আলোচনা সভা ও প্রকাশনা উৎসবে এই কথাগুলো বলেন অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান।
আজ শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
ব্রাত্যজন রিসোর্স সেন্টার-বিআরসি, সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট-সেড এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার-পিপিআরসি সম্মিলিতভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী, চা–শ্রমিক, হরিজন, বেদে, ঋষি, কায়পুত্র, যৌনকর্মী, হিজড়া, জলদাস এবং বিহারি জনগোষ্ঠীর ওপর গবেষণাধর্মী কাজ এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির কাজ করে আসছে এই প্রতিষ্ঠান তিনটি। ধারাবাহিক গবেষণার অংশ হিসেবেই আটটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয় আজকের অনুষ্ঠানে। বইগুলো হলো, ‘রিপোর্ট ও বিশ্লেষণ: বাংলাদেশের প্রান্তিক ও বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী ও তাদের চ্যালেঞ্জ’, ‘বেদে: যাযাবর জীবনের গল্প’, ‘পার্টনার ডিরেক্টরি: প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে’, ‘কমিউনিটি এজেন্ডা: ঋষি ও কায়পুত্র’, ‘ব্রাত্যজন: সামাজিক সুরক্ষা’, ‘কায়পুত্র: শূকর চরানো জনগোষ্ঠী’ ‘টি ওয়াকার্স অব বাংলাদেশ: রিয়ালিটি অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ এবং ‘মধুপুর: অরণ্যের আর্তনাদ’।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পিপিআরসির নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন বলেন, তিনি গত শতকের সেই পঞ্চাশের দশকে তাঁর কর্মজীবন শুরু করার সময় থেকেই মানুষের ন্যায্যতা ও অধিকার নিয়ে কথা বলে আসছেন। ১৯৭১ পূর্ব সময়ে এ অঞ্চল বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল। সেই স্বাধীনতা ছিল আমাদের এক বিরাট অর্জন। তবে স্বাধীনতা লাভের পরও সব বঞ্চনার অবসান হয়নি।
দেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য রেহমান সোবহান বলেন, সমাজের নানা ক্ষেত্রে এখনো সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়ে গেছে। এই বৈষম্য এখন বাড়ছে। বৈষম্যের বড় শিকার প্রান্তিক বিভিন্ন জনজাতির মানুষ। দুর্ভাগ্য, এই সব মানুষের সমস্যার সমাধানের কথা বা বৈষম্য বিলোপের কথা, সেই ষাটের দশক থেকে শুনছি কিন্তু তা এখনো রয়ে গেছে।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নে তাঁর কয়েকটি স্বপ্নের কথা বলেন, যেগুলো তিনি প্রস্তাব হিসেবে তুলে ধরেন। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে প্রান্তিক এবং দরিদ্র প্রতিটি মানুষের জন্য মৌলিক আয়ের ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয় প্রস্তাব প্রতিটি মানুষের জন্য ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা। তৃতীয় প্রস্তাব হিসেবে সামাজিক ব্যবসার সম্প্রসারণের কথা বলেন তিনি।
অনুষ্ঠানে চা–শ্রমিকদের বঞ্চনার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়। চা–শ্রমিকদের বঞ্চনা রোধে মালিকানার একটি অংশ শ্রমিকদের দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তাদের উন্নয়ন তাই কিছুটা সক্রিয় হলেই করা সম্ভব।
অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশের প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষের উন্নয়নে তিনটি প্রস্তাব তুলে ধরেন। প্রথমটি হলো এসব জাতির মানুষের দৃশ্যমানতা বাড়ানো। দ্বিতীয়ত, তাদের কণ্ঠস্বর আরও উচ্চকিত করা। আর তৃতীয় হচ্ছে সার্বিক রাষ্ট্র ও নীতি আলোচনায় তাদের উপস্থিতি তুলে ধরা।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে অন্তবর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তার প্রতি মানুষের অনেক আশা রয়েছে। এই অন্তর্বর্তী সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁদেরও উচিত সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের কথাটা শোনা এবং আগ্রহ নিয়ে শোনা। তাঁদের শোনার ধৈর্য থাকতে হবে।
হোসেন জিল্লুর বলেন, ‘এখন সংস্কার শব্দটি অনেক বেশি করে বলা হচ্ছে। আমি বলতে চাই সংস্কার করতে হবে ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য, শুধু সংস্কার করলে হবে না।’
আজকের অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন সেডের নির্বাহী পরিচালক ফিলিপ গাইন। তিনি বলেন, দেশে বাংলাভাষী ছাড়া অন্তত ১১০টি বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ আছে। তাদের ৪০টির বেশি ভাষা আছে। এখন যে বৈষম্য বিরোধের কথা বলা হচ্ছে এবং নানা সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে এসব জাতির মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক সুরক্ষার বিষয়ে কথা থাকতে হবে।
আজকের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান। তিনি বলেন, ‘আমাদের জনসংখ্যার নিরিখে দেশের প্রান্তিক মানুষের সংখ্যা বেশি নয়। তাদের সমস্যার সমাধানে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি এবং এর বাস্তবায়ন বড় বিষয়।’
অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, সংস্কার এবং অংশীজন—এ দুটো শব্দ এখন বেশ শোনা যাচ্ছে। এখন যেসব সংস্কার কমিশন আছে সেখানে এসব প্রান্তিক মানুষের অংশগ্রহণ কতটা আছে, সেটা বিবেচ্য বিষয়। তাদের কথা তো শুনতে হবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ এম হাশেমী বলেন, প্রান্তিক মানুষের কাছে অর্থনৈতিক অধিকারের চেয়েও বেশি দরকার সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার। সেই অধিকার নিশ্চিত হয়নি, সেটা দুর্ভাগ্যজনক। তিনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থা জানতে জাতীয় পর্যায়ে শুমারি করার প্রস্তাব দেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ভূমিহীনতা একটি যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা। এ দেশের নাগরিক হয়েও কেবল স্থায়ী ঠিকানা না থাকার অজুহাতে চাকরি হয় না। এটা অমানবিক। একটি মানুষও যেন ভূমিহীন না থাকে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক জাকির হোসেন রাজু।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর পক্ষে কথা বলেন এসব গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা।
সেখানে বাংলাদেশ চা–শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন, কোনো বিধি বা আইনের সংস্কার হওয়ার অর্থ হলো এর মাধ্যমে ভালো কিছু হবে। কিন্তু চা–বাগানের মানুষের কাছে সংস্কার ভয় সৃষ্টি করে। ২০০৬ সালের সব আইন একত্র করে শ্রম আইন হয়েছিল। সেখানে দেশের সব শ্রমিকের জন্য নৈমিত্তিক ছুটি রাখা হলেও চা–বাগানের শ্রমিকদের ১০ দিনের ছুটি বাতিল হলো। ২০১৮ সালে শ্রম আইন সংশোধনের সময় চা–শ্রমিকদের এত দিন ধরে পাওয়া গ্রাচ্যুইটি বাতিল হলো।
মধুপুরের জয়েন শাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, মধুপুরের গারোদের ভূমি সমস্যা জটিল হয়ে যাচ্ছে। ভূমির অধিকার না থাকায় গারোরা অনেকেই ঋণ পান না। ফলে কলা বা আনারস চাষে লগ্নি করতে তাঁরা পারেন না। তাঁদের স্থানে বাঙালিরা বিনিয়োগ করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী হেডম্যান কার্বারি নেটওয়ার্কের সভাপতি জয় ত্রিপুরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এখনো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। পাহাড়ের ভূমি সমস্যার সমাধান হয়নি আজও।
ঋষি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ও বেসরকারি সংগঠন পরিত্রাণ এর নির্বাহী পরিচালক মিলন দাস বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এ দেশের ছাত্র–জনতার সঙ্গে ঋষিরাও ছিলেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর ঋষি সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। আন্দোলন ঘিরে যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, তা চুরমার হয়ে গেছে।’
বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের সভাপতি কৃষ্ণলাল বলেন, ‘আমাদের মতো সম্প্রদায়ের মানুষকে রাজনৈতিক দলগুলো মিছিলে সমাবেশে নিয়ে যায়। কিন্তু যখন এসব দলের কমিটি গঠন হয়, তখন আমাদের পাত্তা থাকে না।’