‘যতক্ষণ কবরে না যাব, ততক্ষণ বিচার চাইতে থাকব’

সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির।
ছবি: আসাদুজ্জামান

একটু বেশি বৃষ্টি হলেই বাসার নিচতলায় এক হাঁটু পানি জমে থাকে। ছোট একটা ঘরের ওপর টিনের ছাউনি। বাসার চারদিকে লোহালক্কড়ের দোকান। বাসায় দিনভর লোহা পেটানোর টুং টাং শব্দ কানে ভেসে আসে। পুরান ঢাকার নবাবপুরের এমন একটা বাড়িতেই জন্ম মাছরাঙা টেলিভিশনের সাবেক বার্তা সম্পাদক সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের। আজ থেকে ঠিক ১১ বছর আগে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় সাগর ও তাঁর স্ত্রী এটিএন বাংলার সাবেক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি নির্মমভাবে খুন হন। বিচার দেখে যাওয়ার আশায় দিন গুনতে গুনতে গত বছরের জানুয়ারিতে রুনির মা নূরন নাহার মীর্জা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। এখন বেঁচে আছেন কেবল সাগরের মা সালেহা মনির।

ছেলের নির্মম মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি এই মা। সালেহা মনির বলেন, ‘আমি তো মা। আমার মনের ভেতর অনেক কথা বলে। আদৌ খুনি বের হবে কি না, জানি না। তবে আমি আশা ছাড়ব না। যতক্ষণ কবরে না যাব, ততক্ষণ বিচার চাইতে থাকব।’

ছেলের মৃত্যুর পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকারের কথাগুলো সালেহা মনিরের কানে বাজে। ঘুমের ঘোরেও শুনতে পান সেই ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনি বের করার’ আশ্বাসের কথা। আর আইজিপির তদন্তের ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতির’ কথা আজ তাঁর কাছে নির্মম পরিহাস।

সাগরের মা প্রায়ই বলে থাকেন, লোহালক্কড়ের ভেতর থেকে তিনি সাগর নামের হীরার টুকরা জন্ম দিয়েছেন। সাগর একা ভাই, তাঁর চার বোন। সবাই বেঁচে আছেন। সাগরের জন্ম, বেড়ে ওঠা কিংবা লেখাপড়া—সবই পুরান ঢাকায়। কবি নজরুল কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। এরপর দৈনিক সংবাদ, যুগান্তর, ইত্তেফাক, ডয়েচে ভেলেতে চাকরি করেন। সবশেষ দায়িত্ব পালন করেন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক হিসেবে।

জীবনসঙ্গী মেহেরুন রুনির সঙ্গে পরিচয় সাংবাদিকতার সূত্রে। পরিচয় থেকে প্রেম; এরপর দুই পরিবারের সম্মতিতে তাঁদের বিয়ে হয়। প্রথমে সাগর তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে বাবা-মায়ের ছোট্ট বাসায় সংসার শুরু করেন। তবে নবাবপুরের বাসায় তাঁরা ছিলেন বছরখানেক। রুনি তখন এটিএন বাংলায়; সাগর কাজ করেন দৈনিক ইত্তেফাকে। যাতায়াতের অসুবিধাসহ নানা কারণে নবাবপুরের বাসা ছেড়ে তাঁরা ইন্দিরা রোডের ভাড়া বাসায় পাতেন নতুন সংসার। ভাড়া বাসাতেই এই দম্পতির একমাত্র সন্তান মেঘের জন্ম। এরপর তাঁরা পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় ওঠেন। ইন্দিরা রোডের বাসায় সালেহা মনির অনেকবার গিয়ে থেকেছেন। আর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় শেষ গিয়েছিলেন পবিত্র রোজার ঈদের সময়। আর সাগরের সঙ্গে মায়ের শেষ কথা হয় মৃত্যুর তিন দিন আগে।

সাগর তাঁর মাছরাঙা অফিস থেকে ভরদুপুরে টেলিফোন করেন সালেহা মনিরের মুঠোফোনে। মাকে সাগর বলেছিলেন, ‘মা, তুমি খেয়েছ।’ জবাবে মা বলেছিলেন, ‘বাবা, সাগর। আমি খেয়েছি। তুমি খেয়েছ বাবা।’ জবাবে সাগর বলেছিলেন, ‘মা, এখনো খাইনি। তবে এখন খাব।’

সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি

সাগরের সঙ্গে সেই শেষ কথা আজ মায়ের কাছে পরমধন। ঘুমের মধ্যেও সাগরের ‘মা’ ডাকটি অবচেতন মনে শুনতে পান সালেহা মনির।

গত মঙ্গলবার নবাবপুরের বাসায় ছেলের জন্ম, বেড়ে ওঠার গল্প বলতে বলতে একপর্যায়ে চিৎকার করে কেঁদে বলেন, ‘আজ ১১টি বছর সাগরের মুখে “মা” ডাকটি শুনতে পাইনে। ও সাগর, বাবা আমার।’

সাগরের চার বোনের তিন বোন অন্যত্র যে যাঁর সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আর মঞ্জু আরা পারভীন নামের এক বোন তাঁর একমাত্র সন্তান মুশফিককে নিয়ে মা সালেহা মনিরের বাসায় থাকেন। মুশফিক পুরান ঢাকার একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। সাগরের বোন একটি সংস্থায় চাকরি করেন। বেরিয়ে যান সেই ভোরবেলা; আর ফেরেন সন্ধ্যায়। তবে ছোট্ট মুশফিকের সঙ্গে দিনের বড় একটা সময় কাটে নানি সালেহা মনিরের।

প্রায় সময় সাগরের ছেলে মেঘের কথা মনে পড়ে দাদি সালেহার। মেঘ তার মামার সঙ্গে থাকে। বছরের দুই ঈদের সময় দাদির বাসায় বেড়াতে আসে মেঘ। মুঠোফোনে প্রায় সময় কথা হয় তাঁদের।

দাদির যতটুকু সাধ্য আছে; তার সবটুকু মেঘের জন্য উজাড় করে দেন। সালেহা মনির বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলের একমাত্র সন্তান মেঘ। ও বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হোক, সেটিই আমার চাওয়া।’

সাগর-রুনির যখন মৃত্যু হয়; তখন সালেহার বয়স ৬২ বছর। তখনো শরীর ঠিকঠাক ছিল। তবে ছেলে সাগরের মৃত্যুর পর থেকে প্রায় অসুস্থ থাকেন। চার মেয়ে তাঁর দেখাশোনা করেন; খোঁজখবর নেন। মানসিকভাবে এখনো দৃঢ়চেতা সালেহা মনির।
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে একে একে বলতে থাকেন মনের গহিনে লুকিয়ে থাকা কথা। সালেহা মনির বলেন, ‘মা হয়ে আজও আমি সাগরের কবরের কাছে যাইনি। সাগর খুনের পর আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যত দিন সাগর-রুনির খুনি বের হবে না, তত দিন আমি সাগরের কবর জিয়ারত করতে যাব না। তবে আমি রোজ পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ে সব মৃত ব্যক্তির আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। সেখানে আমার সাগরও থাকে।’

নিহত সাংবাদিক সাগর-রুনি আর ছোট্ট মেঘ

র‌্যাবের উদ্দেশে সালেহা মনির বলেন, ‘পত্রপত্রিকার খবর মারফত জানতে পারতেছি, খুনের ঘটনাস্থল থেকে দুজন অজ্ঞাতনামা পুরুষের ডিএনএ পাওয়া গেছে। সেই দুই ব্যক্তিটা কে? কেন এটা র‍্যাব বের করতে পারে না। আমি খুনিকে দেখতে চাই।’
সালেহা মনির আরও বলেন, ‘র‍্যাব খুনিদের ধরুক, তদন্ত রিপোর্ট জমা দিক, সেটা আমি চাই। র‍্যাবের কর্মকর্তারা আমাকে মায়ের মর্যাদা দিয়েছে। সেই র‍্যাব কি সাগর-রুনির খুনের তদন্ত রিপোর্টটা জমা দেবে না? তখনই র‍্যাবের প্রতি আমার আস্থা আসবে, যখন তদন্ত রিপোর্ট জমা দেবে।’

সাগর-রুনির মৃত্যুর তিন দিন পর সালেহা মনির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। মৃত্যুর ১১ বছর পরও খুনির সন্ধান না পাওয়ায় তিনি ভীষণ ক্ষুব্ধ। মনে জমে আছে তাঁর অনেক কথা।

সালেহা মনির বলেন, ‘সাগর-রুনি খুন হওয়ার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। উনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, মেঘের সব দায়িত্ব তিনি নেবেন। সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী অনুদান হিসেবে সাগরের জন্য দুই লাখ টাকা দিয়েছিলেন। আমি সেই টাকা নিয়েছিলাম। এরপর আর কোনো যোগাযোগ নেই।’

সালেহা মনির বলেন, ‘আমার তো মনে হয় সরকার ইচ্ছা করলে পারে না, এমন কিছু নেই। অনেক কিছুই সরকার পারেন। করেও দেখাচ্ছেন। কিন্তু সাগর-রুনির বেলায় একটু গাফিলতি দেখাচ্ছেন। আমি খুব শিগগির মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে একটি খোলা চিঠি লিখতে চাই। কেন এত বছর লাগছে, আমার ছেলের মামলার তদন্ত করতে?’

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি নৃশংসভাবে খুন হন। সাগর-রুনি হত্যার ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। প্রথমে এই মামলা তদন্ত করছিল শেরেবাংলা নগর থানা-পুলিশ।

চার দিন পর মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিনের মাথায় ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালত র‍্যাবকে মামলা তদন্তের নির্দেশ দেন। তখন থেকে মামলাটির তদন্ত করছে র‍্যাব।

র‍্যাবের পক্ষ থেকে গত ৪ জানুয়ারি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু র‍্যাবের পক্ষ থেকে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি। আদালত আগামী ৫ মার্চ এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নতুন তারিখ নির্ধারণ করেছেন।

আদালতের নথিপত্রের তথ্য বলছে, এ নিয়ে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আদালত ৯৫ বার সময় দিলেন।