পুরান ঢাকার লালবাগ দুর্গের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত ‘ফররুখসিয়ার মসজিদ’। এটিই এখন ‘লালবাগ শাহী মসজিদ’ নামে পরিচিত। আদি মসজিদটির দৈর্ঘ্য ছিল ১৬৪ ফুট, প্রস্থ ৫৪ ফুট। ১৭০৩ থেকে ১৭০৬ সালের মধ্যে মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
মোগল সম্রাট ফররুখসিয়ার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পুরান ঢাকার এই মসজিদ। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম প্রতিষ্ঠার আগপর্যন্ত এটিই ছিল ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় মসজিদ। আয়তনের দিক থেকে প্রথম স্থান হারালেও এখনো এটি ঢাকা শহরের অন্যতম বড় মসজিদ। দোতলা এই মসজিদে একসঙ্গে প্রায় ছয় হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। দোতলার ছাদের ওপর নির্মিত ১২০ ফুট দীর্ঘ আসমানি রঙের মিনারটি চোখে পড়ে অনেক দূর থেকে।
ইতিহাসে এই মসজিদের আদি নাম এর প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে, ‘ফররুখসিয়ার মসজিদ’। তবে সেই প্রাচীন মসজিদটি নেই। সংস্কারের পর নতুন মসজিদটি পরিচিতি পেয়েছে ‘লালবাগ শাহী মসজিদ’ নামে। মসজিদের মূল শিলালিপিটি পাওয়া যায়নি। তবে ইতিহাসবিদেরা মনে করেন ১৭০৩ থেকে ১৭০৬ সালের মধ্যে মসজিদটি নির্মিত হয়। পুরান ঢাকার লালবাগ দুর্গের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এই মসজিদের অবস্থান। আদি মসজিদটির দৈর্ঘ্য ছিল ১৬৪ ফুট, প্রস্থ ৫৪ ফুট।
এশিয়াটিক সোসাইটির ঢাকা কোষ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের মোগল মসজিদগুলোর মধ্যে এটিই আয়তনে সবচেয়ে বড়’। ঢাকা বিশারদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর ‘ঢাকা: স্মৃতিবিস্মৃতির নগরী’ বইতে বলেছেন, ১৭১৭ সালে মুর্শিদ কুলি খাঁ এই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছু জমি ও মাসিক সাড়ে ২২ টাকা বরাদ্দ করেছিলেন।
মসজিদটির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, তা হলো আদি মসজিদটির সমতল ছাদ। মোগল স্থাপত্যে সাধারণত ছাদে এক বা একাধিক গম্বুজ ও কোনো বুরুজ থাকে। এই মসজিদ ছিল তার ব্যতিক্রম। ইতিহাসবিদেরা বলেছেন, মোগল আমলের নির্মিত এটিই একমাত্র সমতল ছাদের মসজিদ। কাঠের মোটা মোটা কড়ি-বর্গা দিয়ে তার ওপর তক্তা বিছিয়ে মসজিদটির ছাদ তৈরি করা হয়েছিল। এক সময় ছাদটি নষ্ট হয়ে যায়। মসজিদ তখন প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে উঠেছিল। ঢাকার নবাব খাজা আবদুল গনি ১৮৭০ সালে পুরোনো ছাদ ভেঙে কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে নতুন ছাদ নির্মাণ করেন।
ফররুখসিয়ার ছিলেন নবম মোগল সম্রাট। তবে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন তাঁর বাবা ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের দৌহিত্র আজিম-উশ-শানের সঙ্গে। সম্রাট ১৬৯৭ সালে আজিম-উশ-শানকে সুবা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত করেছিলেন। পরে তাঁকে পাটনার দায়িত্ব দিয়ে ১৭০৭ সালের দিকে ফররুখসিয়ারকে বাংলা প্রদেশের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ফররুখসিয়ার ১৭১৩ সালে মোগল সম্রাট হিসেবে দিল্লির সিংহাসনে আসীন হন। তবে তার পরিণতি হয়েছিল মর্মান্তিক। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তিনি অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হন। তাঁর চোখ অন্ধ করে দেওয়া হয়। কারাগারে প্রায় অনাহারে, পিপাসায় কাতর হয়ে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
পরিচালনা কমিটির সম্পাদক মনির উদ্দিন আহমদ জানালেন, কবরস্থান, মাদ্রাসা ও মসজিদ মিলিয়ে মোট জায়গা প্রায় দুই বিঘার মতো। শুধু মসজিদ আছে এক বিঘায়। এই মসজিদ ছাড়া ইসলামবাগ এলাকায় মসজিদের নামে কিছু সম্পত্তি আছে।
ঢাকায় আজিম-উশ-শানেরও একটি স্থাপত্য কীর্তি ছিল। তবে তা এখন আর নেই। ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম তাঁর ‘মোগল রাজধানী: ঢাকা’ বইতে উল্লেখ করেছেন লালবাগ কেল্লার দক্ষিণে পোস্তা এলাকায় আজিম-উশ-শান একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি সেখানেই বসবাস করতেন। তবে সেই প্রাসাদটি পরে নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এ কারণে বলা যায় এই বাবা-ছেলের আদি স্থাপনা কোনোটিই এখন আর টিকে নেই।
লালবাগ শাহী মসজিদটির পরিচালনা কাজে টানা ৫২ বছর ধরে সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন মনির উদ্দিন আহমেদ। মসজিদের পাশেই তাঁর বাসভবন। ‘খোকা ভাই’ বলেই তিনি স্থানীয় সর্বজনে পরিচিত। গত বুধবার কথা হলো তাঁর সঙ্গে। তিনি জানালেন, ১৯৭২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মসজিদ পরিচালনা কমিটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তার পর থেকে কাজ করে চলেছেন। বেশ কয়েকবার মসজিদটির সংস্কার করা হয়েছে। সামনের অংশে সংস্কার শুরু হয় ১৯৭৩ সালে, শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। এপরে ১৯৯২ সালে আরেকবার সম্প্রসারণের কাজ করা হয়।
মসজিদের দোতলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে। ছাদে তৈরি করা হয়েছে ১২০ ফুট দীর্ঘ মিনার। মসজিদের তৃতীয় তালার কাজ শুরু হবে এই ঈদুল ফিতরের পরে। এলাকার কিছু ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, পরিচালনা কমিটির সদস্য, স্থানীয় ব্যবসায়ীও মুসল্লিদের দান ও সম্পত্তির ভাড়ার আয় থেকে মসজিদের সংস্কার, সম্প্রসারণ, পরিচালনার কাজ চলছে। তিনি জানালেন মসজিদ ছাড়া এখানে ‘মাদ্রাসা জামিয়া কোরানিয়া আরাবিয়া লালবাগ’ নামে একটি মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। এখন প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে এখানে।
লালবাগ শাহী মসজিদের সঙ্গে একটি প্রাচীন কবরস্থানও রয়েছে। পরিচালনা কমিটির সম্পাদক মনির উদ্দিন আহমদ জানালেন, কবরস্থান, মাদ্রাসা ও মসজিদ মিলিয়ে মোট জায়গা প্রায় দুই বিঘার মতো। শুধু মসজিদ আছে এক বিঘায়। এই মসজিদ ছাড়া ইসলামবাগ এলাকায় মসজিদের নামে কিছু সম্পত্তি আছে। সেখান থেকে ভাড়া বাবদ কিছু আয় আসে।
পোস্তা সড়কের সঙ্গেই মসজিদের প্রধান প্রবেশ পথের সিঁড়ি। দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেই পড়বে অজুখানা। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা দুটি বড় দিঘি পানিতে ভরা। পাশেই অজুর জন্য বসার জায়গা। এরপর থেকেই মসজিদের সম্প্রসারিত অংশ। সেটি পার হলে মূল মসজিদ। পশ্চিমের দেয়ালে মূল মেহরাবটি অর্ধ গম্বুজাকার। ভেতরে খিলান আকৃতির নকশা। এই নকশা করা হয়েছে লালবাগ কেল্লার ভেতরে নকশার অনুসরণে।
ফররুখসিয়ার ১৭১৩ সালে মোগল সম্রাট হিসেবে দিল্লির সিংহাসনে আসীন হন। তবে তার পরিণতি হয়েছিল মর্মান্তিক। কারাগারে প্রায় অনাহারে, পিপাসায় কাতর হয়ে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মসজিদের ভেতরে এখন বহু মুসল্লি রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের ইতিকাফে বসেছেন। অনেকে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করছেন, কেউ নামাজ আদায় করছেন। মোয়াজ্জিন মোহাম্মদ ওমর ফারুক জানালেন, এখন প্রতি জুমায় মসজিদের দোতলা ছাড়াও ছাদ এবং সামনের রাস্তায় জামায়াত হয়। ফলে সাত হাজারের মতো মুসল্লি নামাজ আদায় করেন।
ঈদের পরে তিনতলার কাজ শুরু হবে। তৃতীয় তলার নির্মাণ শেষ হলে আরও অনেক মুসল্লি এখানে নামাজ আদায় করতে পারবেন। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে যায়। ফররুখসিয়ারের মসজিদটির ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটেছে। আদি মসজিদের জায়গায় এখন দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক স্থাপত্যের এক নান্দনিক স্থাপনা। এর মিনারটিও বেশ অভিনব ধরনের। তৃতীয় তলার কাজ শেষ হলে আরও অনেক মুসল্লির প্রার্থনার স্থান সংকুলান হবে। তাঁরা নিজেদের জন্য তো বটেই, দেশ জাতি জন্যও প্রার্থনা করবেন। তাঁদের প্রার্থনায় তিন শতাব্দীর প্রাচীন মসজিদটি ঢাকার ইতিহাসে-ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে কালজয়ী হয়ে থাকবে।