ঢাকাকে রক্ষায় বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া বিকল্প উপায় নেই

নগরায়ণে বাংলাদেশ ও নগর পরিবেশ’ শীর্ষক সম্মেলনে অতিথিরা। ঢাকা, ১৮ মে
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

দেশের নগরে বসবাসকারী জনসংখ্যার প্রায় ৩৯ শতাংশই থাকে মেগা সিটি ঢাকায়। যাদের বড় অংশই অভিবাসী হিসেবে অন্যান্য জেলা থেকে এসেছে। একদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। অন্যদিকে নগর ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের অভাবে বাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে ঢাকা। ঢাকাকে রক্ষায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও উন্নয়নকাজের কার্যকর বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই।

আজ শনিবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে ‘নগরায়ণে বাংলাদেশ ও নগর পরিবেশ’ শীর্ষক সম্মেলনের আলোচনায় এসব কথা উঠে আসে। নগর গবেষণা কেন্দ্রের ৫২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দিনব্যাপী এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

উদ্বোধনী অধিবেশনে ‘বাংলাদেশের নগরায়ণ, নগর ঢাকা এবং বিকেন্দ্রীকরণ চিন্তা’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নগর গবেষণা কেন্দ্রের সাম্মানিক চেয়ারম্যান ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। এতে বলা হয়, ঢাকা জেলায় প্রান্তিক জেলার তুলনায় উচ্চহারে নগরায়ণ হয়েছে। ঢাকায় বসবাসকারী ৬০ শতাংশের বেশি পরিবারের প্রধান হিসেবে যাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরা অন্য জেলা থেকে অভিবাসী হিসেবে ঢাকায় এসেছেন। গ্রামীণ দারিদ্র্য, ভূমিহীনতা, নদীভাঙন ও উপকূলীয় দুর্যোগ নগরমুখী অভিবাসন তীব্রতর করেছে। নগরের অর্থনৈতিক শক্তি, উন্নত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাও বড় আকর্ষণ।  

প্রবন্ধে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, জাতীয় নগর নীতিমালার খসড়াতে বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ২০১১ সালের এই নীতিমালা চলতি বছর পরিমার্জন করা হয়েছে। অবিলম্বে এই নীতিমালার অনুমোদন এবং বিকেন্দ্রীকরণ ও নগর পরিচালনের ওপর জোর দিয়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
এই অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কিন্তু জোর করে নগরায়ণ বন্ধ করা যাবে না। গ্রামীণ এলাকায় নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ ও সুষম উন্নয়ন ব্যতীত অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ঠেকানো সম্ভব হবে না।  

উপজেলা ও পৌরসভাগুলো মানুষকে বসবাসের জন্য আকর্ষণ করতে পারছে না কেন, সেটি মূল্যায়ন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। তিনি বলেন, অপরিকল্পিতভাবে গ্রামীণ এলাকার রূপান্তর হচ্ছে। কৃষিজমি দ্রুত কমছে। পরিকল্পিতভাবে উপজেলা পর্যায়ে উন্নয়নে জোর দিতে হবে।

বর্তমান নগর দর্শনকে ‘ভ্রান্তিবিলাস’ বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সহসভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, এই ভ্রান্তিবিলাস এক দিনে তৈরি হয়নি। বাড়ির বহুতল হয়েছে, এখন সড়কের বহুতল চলছে। সাধারণ মানুষের গণপরিসর, গণপরিবহন ও গণচলাচল নিশ্চিত করতে প্রকৃত প্রকল্প হয়নি। গণপরিবহনের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মেট্রো শুরু করেছি, কিন্তু সবচেয়ে সহজ ফুটপাত নিশ্চিত করতে পারিনি।

সব ধ্বংস করে নগরায়ণের একটি ধারা দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবেশ ধ্বংস দেখলে মনে হয়, দেশের উন্নয়ন দর্শন ভুল পথে গেছে। সরকারের মধ্যে বসে থাকা ব্যবসায়ীদের যত্রতত্র কৃষিজমি ভরাট করে শিল্পকারখানা করার লালসা পূরণ করতে দিলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না।    

নগর গবেষণা কেন্দ্রের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সৈয়দা ইসরাত নাজিয়ার সঞ্চালনায় এই অধিবেশনের আরও বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কালাম ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইসরাত ইসলাম। এরপর ‘ঢাকা এখন ও আগামীতে’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা।

৩৫ শতাংশ মানুষ বস্তিতে

‘নগরায়ণ ও পরিবেশ’ শীর্ষক দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আতিউর রহমান। তিনি বলেন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলোর বিকেন্দ্রীকরণ না হলে ঢাকা চুম্বকের মতো টানতে থাকবে। জলবায়ু অভিবাসী হিসেবে যারা ঢাকায় ঢুকছে, তারা কোনো নাগরিক সুবিধাই পাচ্ছে না।

এই অধিবেশনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নগর গবেষণা কেন্দ্রের কোষাধ্যক্ষ সালমা এ শফি। তাতে বলা হয়, ঢাকায় অভিবাসন করা জনগোষ্ঠীর ২১ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত। দেশের বিভাগীয় শহরগুলোর মোট আয়তনের মাত্র ৪ শতাংশ বস্তি। কিন্তু শহরের জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশের বেশি মানুষ বস্তিতে থাকে। কিছু বস্তিতে প্রতি বর্গমাইলে এক লাখের বেশি লোক বসবাস করে।  

নগরায়ণে বাংলাদেশ ও নগর পরিবেশ’ সম্মেলনে ‘ঢাকা এখন ও আগামীতে’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। ঢাকা, ১৮ মে

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, আগের পরিকল্পনায় যেগুলো পানিপ্রবাহ অঞ্চল ছিল, এবারের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় সেগুলো থাকল না। এই পানিপ্রবাহ অঞ্চল কারা খেয়ে ফেলল? বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রকল্প নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এই প্রকল্প কারও প্ররোচনায় নেওয়া হলো নাকি সত্যিকার জনস্বার্থে করা হচ্ছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

নগর গবেষণা কেন্দ্রের মারুফ হোসেনের সঞ্চালনায় এই অধিবেশনে আরও বক্তব্য দেন ফারইস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক রকীব আহমেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অলক পাল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ আবদুল কাদের ও পরিবেশবিদ বিধান চন্দ্র পাল।

নতুন প্রজন্ম দোষারোপ করবে

‘বাংলাদেশের নগরায়ণ: দুর্যোগ, দুর্ঘটনা ও স্মার্ট সিটি’ শীর্ষক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন মো. জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘নগরায়ণের যে সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত সমস্যা। কিন্তু সমাধান করা যাচ্ছে না। এই নগরকে বাসযোগ্য না করতে পারলে নতুন প্রজন্ম আমাদের দোষারোপ করবে।’

দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নগর গবেষণা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম ও সাম্মানিক সহসভাপতি মো. গোলাম মরতুজা। বিধান চন্দ্র পালের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক মো. হুমায়ুন কবির, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আলী হায়দার ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির। সমাপনী অধিবেশনে ‘বাংলাদেশের বালু সম্পদ’ নিয়ে একটি পর্যালোচনার প্রাথমিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।