দিদারুল হক জুনায়েদ
দিদারুল হক জুনায়েদ

‘জুনায়েদরে পাইছস? মরে গেছে?’

কয়েক বছর আগে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন মাইনুল হক। শুক্রবার ভোরে তিনি তাঁর শ্যালক কে এম সোহেলকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘জুনায়েদরে পাইছস?’ তখন সোহেল আস্তে করে বলেছিলেন, ‘পাইছি।’ তারপরই মাইনুল হক বলেন, ‘মরে গেছে?’

গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডে সাততলা গ্রিন কজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন মাইনুল হকের ছেলে দিদারুল হক জুনায়েদ। কে এম সোহেল জুনায়েদের মামা। ঘটনার দিন জুনায়েদ বন্ধুদের সঙ্গে মিলে সেখানে খেতে গিয়েছিল।

আগুনে জ্বলেপুড়ে ছারখার হওয়া বেইলি রোডের ভবনটি

আজ শনিবার মোবাইলে কে এম সোহেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে একটি মরদেহের আঙুলের তিনটি আংটি দেখে বুঝতে পারি, এটি জুনায়েদের লাশ। তারপর বিভিন্ন যাচাই–বাছাই শেষে লাশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর লাশ গোসল করানোর জন্য মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে আঞ্জুমান মুফিদুলে নিয়ে যাই। তখন পর্যন্ত আমার মা, বোন আর দুলাভাইকে “জুনায়েদ নেই” তা জানাইনি। ভোরে দুলাভাই ফোন করলে তখন বলতে বাধ্য হই।’

রাজধানীর উত্তরায় থাকেন ব্যবসায়ী সোহেল। তাঁর বোন জুনায়েদের মা শামসুন নাহার পারভীনদের বাসা শান্তিনগরে। সোহেল বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডে আগুন লেগেছে, এ খবর দেখি। ভাবি, এমন তো কতই হয়। ঘুমিয়ে পড়ি। রাত ২টা ৪০ মিনিটের দিকে বোন ফোন করে জানান, জুনায়েদ আগুন লাগা ভবনে গিয়েছিল, এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর তো...।’

আগুন জ্বলছে বেইলি রোডের বহুতল ভবনে।

জুনায়েদ রাজধানীর স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেছিলেন। ইচ্ছে ছিল বিদেশ গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়বেন। সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।

জুনায়েদের লাশ ভোলায় দাফন করা হয়েছে। তাঁর শরীরের প্রায় ৭০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল বলে পরিবার জানতে পেরেছে। দুই বোনের এক ভাই ছিলেন জুনায়েদ। জুনায়েদের বড় বোন তাসনিম হক চিকিৎসক। ছোট বোন জোবাইদা হক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।

জুনায়েদের মামা কে এম সোহেল বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে বোনের ফোন পেয়ে প্রথমে বেইলি রোডের ওই ভবনে যাই। গিয়ে দেখি উদ্ধারকাজের দায়িত্বপ্রাপ্তরা সব কাজ গুছিয়ে সব বন্ধ করে দিচ্ছেন। জুনায়েদের বর্ণনা দিয়ে জানাই আমার ভাগনাকে খুঁজে পাচ্ছি না। তখন দায়িত্বপ্রাপ্তরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে খোঁজ নিতে বলেন।’

একজন বাবাকে তাঁর সন্তান নেই, এটা জানানো কতটা কঠিন, সেই অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে সোহেল বলেন, ‘চোখের সামনে এইটুকুন একটা ছেলে মরে গেছে, এটা মানতে পারছিলাম না। অন্যদিকে রাতে আমার মা এবং বোন ও দুলাভাইকে এই খবরটাও জানাতে পারছিলাম না। এ পরিস্থিতিতে কেউ না পড়লে এটা যে কতটা কষ্টের, তা কেউ বুঝতে পারবে না। তারপর সবচেয়ে কঠিন কাজ অর্থাৎ ছেলে মারা গেছে, এ খবরটাও দুলাভাইকে আমিই জানাই।’

রাজধানীতে আগুন লাগা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ভাগনেকে হারিয়ে এ আগুনের ভয়াবহতা টের পেয়েছেন সোহেল। তিনি বললেন, ‘ভরসার জায়গাটিই আমরা হারিয়ে ফেললাম।’

ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বেইলি রোডে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জানিয়েছে, ভবনটিতে রেস্তোরাঁ বা পণ্য বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কোনো অনুমোদন ছিল না। বেইলি রোডের ওই ভবনের আগুনে এ পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

মা–বাবা, বোনদের সঙ্গে জুনায়েদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুমিত আল রশিদের আপন খালাতো বোনের ছেলে ছিলেন জুনায়েদ। তিনি জানালেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে জুনায়েদকে দেখার সাহস পাননি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এ শহরে বিনোদনের জায়গা নেই। পরিবার–পরিজন নিয়ে রেস্তোরাঁয় খেতে যান অনেকে। তবে সেখানেও যদি এত মৃত্যুফাঁদ থাকে, তাহলে মানুষ কোথায় যাবে?

‘সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হায়েনাদের বিচরণ, দুর্নীতি গ্রাস করে ফেলছে। জুনায়েদকে আর ফিরে পাব না। স্বজন–হারানো পরিবারের সদস্য হিসেবে কার কাছে বিচার দেব—এ প্রশ্ন মুমিত আল রশিদের।

অন্ধকারে গেলেই মনে হয় সিঁড়িতে আটকে আছি

বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের গ্রিন কজি কটেজ নামের ভবনটির চতুর্থ তলায় খানাস রেস্তোরাঁয় জুনায়েদসহ চার বন্ধু খেতে গিয়েছিলেন। সেদিন চারজনের মধ্যে একজন ছিলেন সিয়াম আহমেদ। তিনি বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন ওই ভবন থেকে। সিয়াম আর জুনায়েদ পাশাপাশি বাসায় ছোট থেকে বড় হয়েছেন। সেই বন্ধুকে হারিয়ে সিয়াম মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।

সিয়াম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন খাবার অর্ডার করে নিজেরা সেলফি তুলছিলাম। আমি বাথরুমে গেলাম। লাইট বন্ধ হয়ে গেল। ভাবলাম কারেন্ট চলে গেছে। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে বাথরুম থেকে বের হলাম। কিন্তু দেখি পুরো জায়গা অন্ধকার, কোনো মানুষ নেই। বুঝতে পারি, বড় কিছু একটা হয়েছে। তারপর ধোঁয়া, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম...কোনোভাবে নিচে নামতে পেরেছিলাম। তখনো ভাবছি আমি যেহেতু বের হতে পেরেছি, তাহলে জুনায়েদ ও অন্যরাও নিশ্চয়ই নিচে নেমে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু তা হলো না। জুনায়েদ মারা গেল। একজনের লাশ ডিএনএ পরীক্ষা করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। অন্য একজন বেঁচে আছে।’

সিয়াম বলেন, ‘আমার শারীরিকভাবে তেমন ক্ষত হয়নি। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে জীবনটাই তো পাল্টে গেল। অন্ধকারে গেলেই মনে হয় আটকা পড়া ভবনের সিঁড়িতে আছি আমি। জুনায়েদের মোবাইলে বন্ধুরা মিলে শেষ সেলফি তুলেছিলাম। সেই সেলফিটাও হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য।’