রমজানের প্রথম দিনে চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। গতকাল বিকেলে
রমজানের প্রথম দিনে চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। গতকাল বিকেলে

রোজায় বদলে যাওয়া জীবন

দিনে–রাতে ব্যস্ততা এখন অন্য রকমের। সকাল থেকে অফিস–আদালত, স্কুল–কলেজে যাওয়ার তাড়া থাকলেও প্রাতরাশের তোড়জোড় নেই। রান্নাঘরে চুলায় দহনবিরতি। ব্যাংক–ব্যবসায় লেনদেনে বেলা আড়াইটা নাগাদ ইতি। অন্য সব অফিসেও কাজের সময় এগিয়ে আনা হয়েছে। প্রতিবছর জীবনযাত্রায় এমন পরিবর্তন নিয়ে আসে পবিত্র মাহে রমজান। আমাদের মতো মুসলিমপ্রধান দেশে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে অগণিত মানুষ মহান আল্লাহর ক্ষমা, অনুগ্রহ ও পুণ্য লাভের আশায় রোজা রাখেন। সে কারণেই রমজানে জীবনাচরণের পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি সমাজের সর্বত্রই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি।

রমজান মাসের চাঁদ দেখা নিয়ে এবার তেমন কোনো অনিশ্চয়তা ছিল না, গতকাল মঙ্গলবার থেকে যে রোজা রাখা শুরু হবে, তা মোটের ওপর সবাই নিশ্চিতই ছিলেন। সোমবার রাত থেকেই মসজিদগুলোতে তারাবিহ নামাজের জামাত শুরু হয়ে যায়। শেষ রাতে সাহ্‌রি খেয়ে গতকাল থেকে পবিত্র রমজান মাসের সিয়াম সাধনা শুরু করেছেন সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা।

বিকেলের ব্যস্ততা আবার আরেক রকম। রাজধানীতে হোটেল-রেস্তোরাঁর তো ঝাঁপ নামানোই ছিল সকাল থেকে, পথের পাশে, পাড়ার মোড়ের চায়ের টংদোকানগুলোও ছিল বন্ধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনের ফুটপাত, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে যেসব চায়ের দোকান, যেগুলো নানা বয়সী মানুষের সমাগমে সরগরম থাকে, গতকাল সকাল থেকে সেগুলো ছিল পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে রাখা। দুপুরেও দেখা গেল দোকানগুলো বন্ধ। ফলে লোকজন নেই। নিরিবিলি, নির্জন।

হাতের কাজ দ্রুত শেষ করে বেলা গড়ানোর পর থেকেই সবার মধ্যে তাড়া ছিল বাসাবাড়িতে ফেরার। তাঁরা চেষ্টা করেছেন প্রথম রোজায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একত্রে বসে ইফতার করতে। এ কারণে দুপুরের পর থেকে ঢাকার পথে পথে যেমন যানজট বেড়েছিল, তেমনি ইফতারের দোকানগুলোতেও বাড়ে ক্রেতাদের উপস্থিতি।

ঐতিহ্যবাহী ইফতারির পসরা সাজিয়ে বেচাকেনার পর্ব শুরু হয় দুপুরের পর। চকবাজারে চক্কর দিয়ে দেখা গেল, ফিরে এসেছে সেই চেনা দৃশ্য। চকবাজার শাহি জামে মসজিদের সামনের সড়কে জোহরের আজান শুরু হতে না হতেই বসে যায় ভাজাপোড়া, ঝাল-মিষ্টির হরেক রকম পদ নিয়ে পুরান ঢাকার বিখ্যাত ইফতারির বাজার। চকের এই মসজিদ স্থাপন করেছিলেন ইতিহাসখ্যাত ঢাকার সুবাদার শায়েস্তা খান। তবে তাঁর নামনিশানা ইতিহাসের বইয়ের পাতা ছাড়া এখানে কোথাও নেই।

এখানে এখন ব্যস্ত মানুষের হাঁকডাক। ভিড় ঠেলে এগিয়ে চলা জনস্রোত। ক্রেতাদের পাশাপাশি অনেক গণমাধ্যমকর্মী, ক্যামেরা নিয়ে চিত্রগ্রাহক, মুঠোফোন হাতে টিকটক ভিডিও নির্মাতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়জনদের কর্মচাঞ্চল্য। প্রকাণ্ড কড়াইয়ে গরম তেলে চলছে বেগুনি, পেঁয়াজু, জিলাপি ভাজা। টেবিলের ওপরে থরে থরে সাজিয়ে রাখা খাসির আস্ত রানের রোস্ট; আগুন ঝলসানো হচ্ছে মুরগি, গরুর শিককাবাব। আছে হাঁস, কবুতর, কোয়েল পাখির রোস্ট। বটি, রেশমি, ক্ষীরি, জালি—এমন নানাবিধ কাবাবের ওপরে কাবাবকুলশিরোমণির সাজিয়ে রাখা, জাম্বো সাইজের সুতি কাবাব। চর্ব্য–চূষ্য–লেহ্য–পেয় কী নেই সেখানে! বসন্তের পড়ন্ত বেলার বাতাসে ভাসছে সেসব হরেক সুস্বাদু ইফতারির ঘ্রাণ। তবে মহার্ঘ সেসব খাবার। এর অনেক কিছুই সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের রসনা স্পর্শের চেয়ে অনেক তফাতে।

চকবাজারের ইফতারির বাজারে তৈরি করা হচ্ছে জাম্বো সাইজের জিলাপি। গতকাল বিকেলে

দরদাম জানতে বিক্রেতাদের জিজ্ঞাসা করতে জানালেন, সব রকম কাবাব ও মাংসের উপকরণের দাম গত বছরের চেয়ে এবার অন্তত শতকরা ১০ ভাগ বেশি। গরুর মাংসের সুতি কাবার ১ হাজার ২০০ এবং খাসির ১ হাজার ৪০০ টাকা কেজি। খাসির রান প্রতিটি ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা, আস্ত হাঁস ১ হাজার ২০০, মুরগি ৪৫০, কবুতর ৫০ ও কোয়েল পাখির রোস্ট ৪০ টাকা। গরুর বটি কাবাব প্রতি প্লেট ২৫০ টাকা।

টিকিয়া নার্গিস, মুঠি, কাঠি কাবাব—এসব ৪০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত প্রতিটি। তন্দুরি চিকেন ১৫০ টাকা। প্লেন টানা পরোটা ৩৫ টাকা, চিকেন পরোটা ৬০ ও গরুর কিমার পরোটা ৭০ টাকা প্রতিটি। দই বড়া ১০টির বাটি ৩০০ টাকা। ফালুদার বাটি ১০০ টাকা, ২৫০ মিলিলিটার পেস্তার শরবত ১৫০ টাকা। সামান্য যাঁদের উপার্জন, তাঁদের পক্ষে এসব কেবল দেখাই সার! তাঁদের জন্য আছে বেগুনি, পেঁয়াজু, সবজির বড়া—আকারভেদে প্রতিটির দাম ৫ থেকে ৭ টাকা।

জিনিসপত্রের দাম বেশি, তাই ইফতারির খাবারেও তার প্রভাব—রমজান মাসের এই বাজারচিত্র এখন যেন ধ্রুপদি হয়ে উঠেছে। রমজান মাসের প্রকৃত তাৎপর্য ত্যাগের মহিমায়। এই মাসে সংযমের মাধ্যম আত্মশুদ্ধির মর্তবার কথা কারও অজানা নয়, কেউ ভুলেও যাননি—এ–ও নিশ্চিত। তবু প্রতিবছর রমজানে আচমকাই বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে। প্রবল চাপ পড়বে সীমিত আয়ের মানুষের সংসারে। এই তো হয়ে আসছে।

মহান আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওদা হাসিলের জন্য তাঁর অনন্য নিয়ামত হিসেবে পবিত্র মাহে রমজান ইমানদার বান্দাদের দান করেছেন। দান গ্রহণের জন্যও গ্রহীতাকে উপযুক্ত হতে হয়, এ কথাও কারও জানাবোঝার বাইরে নয়। জীবনযাত্রার অভ্যাস পরিবর্তনের মতো এই রমজানের তাৎপর্য ধারণ করে আমরা প্রকৃতপক্ষে আপন অন্তরাত্মাও বদলে ফেলতে পারব—এই প্রত্যাশা থাকুক সবার অন্তরে।