শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি—সবকিছুর জন্য দেশের মানুষ রাজধানীমুখী। অনেকেরই কাছে রাজধানী ঢাকা ‘সিটি অব অপরচুনিটি বা সুযোগের শহর’। এই নগরকে তাই সামলাতে হয় জনসংখ্যার প্রবল চাপ। একটি নগরকে কেন্দ্র করে এত সুযোগের যে সমাহার, তাকে অসম বলে মনে করে উন্নয়ন তাত্ত্বিকেরা। তাঁদের কথা, উন্নয়ন ক্রমে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এর সুফল রাজধানীর বাইরের মানুষ পাচ্ছে না।
গত বুধবার প্রকাশিত হলো জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২–এর প্রাথমিক প্রতিবেদন। সেখানেও দেখা গেছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা সামাজিক খাতে ঢাকা বিভাগ এগিয়ে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই বিভাগের এত রমরমা রাজধানীর জন্যই।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘ঢাকা এবং এর বাইরের আরেকটি বাংলাদেশ—এমন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে সবকিছু। উন্নয়নের বিদ্যমান চর্চা এমন একটি বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছে। সামাজিক সূচকে তাই কেন্দ্রই এগিয়ে।’
সাক্ষরতার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে ঢাকা বিভাগ। এই বিভাগে সাক্ষরতার হার ৭৮ দশমিক শূন্য ৯। এরপরই আছে বরিশাল বিভাগ। এখানে সাক্ষরতার হার ৭৭ দশমিক ৫৭।
হোসেন জিল্লুর ‘কেন্দ্রীভূত’ উন্নয়ন চর্চার যে কথা বললেন, শিক্ষাসহ সব সূচকে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শুরু করা যাক শিক্ষা দিয়ে। সাক্ষরতার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে ঢাকা বিভাগ। এই বিভাগে সাক্ষরতার হার ৭৮ দশমিক শূন্য ৯। এরপরই আছে বরিশাল বিভাগ। এখানে সাক্ষরতার হার ৭৭ দশমিক ৫৭। সাক্ষরতার ক্ষেত্রে বিভাগ পর্যায়ে ঢাকা এগিয়ে থাকলেও জেলা হিসেবে সাক্ষরতার হার সবচেয়ে বেশি বরিশাল বিভাগের পিরোজপুরে।
এখানে সাক্ষরতার হার ৮৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। এরপরই আছে ঢাকা জেলা। এখানে সাক্ষরতার হার ৮৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ। সাক্ষরতার ক্ষেত্রে পিরোজপুরের মতো একটি জেলার এগিয়ে থাকা এবং ঢাকার মতো রাজধানীর পিছিয়ে থাকার বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়েছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ঢাকা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু।
কিন্তু এই নগরের মধ্যেও কেন্দ্র ও প্রান্তের মতো বৈষম্য রয়েছে। নগরের নানা নাগরিক সুবিধা থেকে নিম্নআয়ের মানুষ পিছিয়ে ব্যাপকভাবে। নগরের বিশাল জনগোষ্ঠী শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্যই এখানে আছেন। বিনিময়ে কোনো সামাজিক সুবিধা তাঁরা পান না।
সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের সুযোগ পাওয়া সামাজিক অগ্রগতির একটি সূচক হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশ এ খাতে গত কয়েক দশকে যথেষ্ট উন্নতি করেছে। বিশেষ করে খোলা জায়গায় মলত্যাগের অভ্যাস কমানোতে বাংলাদেশের অর্জন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০০২–এ টয়লেট সুবিধার ধরন তুলে ধরা হয়েছে। দেখা গেছে, জাতীয় পর্যায়ে ৫৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ পরিবারে ফ্ল্যাশ করে বা পানি ঢেলে নিরাপদ নিষ্কাশনের টয়লেট সুবিধা আছে। দেশের ১ দশমিক ২৩ শতাংশ পরিবারে টয়লেট সুবিধা নেই।
বিভাগের হিসাবে ঢাকার সর্বোচ্চ ৬৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ পরিবার ফ্ল্যাশ করে বা পানি ঢেলে নিরাপদ নিষ্কাশন করে। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে আছে চট্টগ্রাম। তবে স্ল্যাবসহ পিট ল্যাট্রি বা ভেন্টিলেটেড উন্নত শৌচাগার বেশি রয়েছে বরিশালে। এর হার প্রায় ৪২ শতাংশ।
দেশে খোলা জায়গায় মলত্যাগের হার সবচেয়ে কম ঢাকা বিভাগে। এর হার শূন্য দশমিক ২৮। এরপরই আছে বরিশাল বিভাগ। এ বিভাগের খোলা জায়গায় মলত্যাগের হার শূন্য দশমিক ৩০। খোলা জায়গায় মলত্যাগের হার সবচেয়ে বেশি রংপুরে, ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। রংপুরের পরই আছে সিলেট বিভাগ। এখানে খোলা জায়গায় মলত্যাগের হার ২ দশমিক ৬৫।
জাতীয় পর্যায়ে ৮৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ পরিবারের খাবার পানির উৎস গভীর ও অগভীর টিউবওয়েল। আর প্রায় ১২ শতাংশ পরিবারের খাবার পানির উৎস ট্যাপ বা সাপ্লাইয়ের পানি। রংপুর বিভাগে সর্বোচ্চ প্রায় ৯৯ শতাংশ পরিবারের খাবার পানির উৎস গভীর ও অগভীর টিউবওয়েল। আর ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ২৬ শতাংশের বেশি পরিবার খাবার পানি পায় ট্যাপ ও সরবরাহের পানি থেকে।
শুমারির এসব উপাত্ত কিছু বাস্তবতাকে তুলে ধরে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইডের বাংলাদেশপ্রধান হাসীন জাহান। তাঁর মতে, সেই বাস্তবতা হলো রাজধানী বা নগরের সঙ্গে প্রান্তের বৈষম্য এখনো প্রকট। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে, অবকাঠামো হচ্ছে। বেশির ভাগই হচ্ছে রাজধানীতে। আবার রাজধানীর বাইরে পানি ও স্যানিটেশনের সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠানও একের পর এক প্রকল্প নিচ্ছে।
কিন্তু তাদের সেই সক্ষমতা আছে কি না, তা যাচাই করা হচ্ছে না। ফলে এসব প্রকল্প থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল আসছে না।’ উন্নয়ন পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে পানি ও স্যানিটেশন পিছিয়ে পড়া এলাকাকে প্রাধান্য দিতে হবে বলে মনে করেন হাসীন জাহান। তিনি বলেন, ‘শুমারির প্রতিবেদন আমাদের জানান দিচ্ছে কোন জায়গায় কীভাবে কাজ করতে হবে। শুধু সরকার নয়, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।’
পাঁচ বছর এবং এর ঊর্ধ্বে মুঠোফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে এগিয়ে ঢাকা বিভাগ। এ বিভাগের ৬২ শতাংশের বেশি এ বয়সী মুঠোফোন ব্যবহার করে। এরপরই আছে বরিশাল বিভাগ। এই বিভাগের এ বয়সী ৫৬ শতাংশ মুঠোফোন ব্যবহার করে। ১৮ বছর ও এর চেয়ে বেশি বয়সীদের মধ্যে মুঠোফোন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় ঢাকা বিভাগে। বিভাগে প্রায় ৭৮ ভাগ এই বয়সী মানুষ মুঠোফোন ব্যবহার করে।
এই বয়সীদের মধ্যে মুঠোফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে চট্টগ্রাম ও বরিশাল। শুমারি প্রতিবেদনে পাঁচ বছর বা এর ঊর্ধ্বের এবং ১৮ বছর এবং এর ঊর্ধ্বের জনসংখ্যার গত তিন মাসে ইন্টারনেট ব্যবহারে শতকরা হার তুলে ধরা হয়েছে।
দেখা গেছে, পাঁচ বছর ও এর বেশি বয়সীদের মধ্যে ৩০ দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং ১৮ বছর ও এর বেশি বয়সীদের ৩৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ গত তিন মাসে ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে। বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত তিন মাসে উভয় শ্রেণির বয়সীদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে এমন জনসংখ্যা ঢাকায় সবচেয়ে বেশি, সবচেয়ে কম রংপুর।
ঢাকা অর্থনৈতিকভাবে বেশি সক্ষম জনগোষ্ঠীর এলাকা। সেটাই এর এগিয়ে থাকার মূল কারণ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেসের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম। তবে তাঁর মতে, এটি কেন্দ্রীভূত উন্নয়ন চর্চাই ফসল। অধ্যাপক মঈনুল প্রথম আলোকে বলেন, সঠিক জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা দরকার। শুমারিতে যেসব এলাকা পিছিয়ে আছে, সেসব এলাকার জন্য বিশেষ উন্নয়ন উদ্যোগ দরকার। শুমারির তথ্যের যথাযথ ব্যবহার তাতেই সম্ভব।