কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে সরকারের নির্দেশে দেশের ভেতরে সব ধরনের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ ছিল। এ কারণে প্রথম আলো ডটকমে কোনো সংবাদ বা লেখা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। যদিও এ কয়েক দিনে নানা ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সংঘাত–সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৯৭ জন। সংকট নিরসনে সরকারও একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এ সময়ে ছাপা পত্রিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য উল্লেখযোগ্য সংবাদ ও লেখাগুলো অনলাইনে প্রকাশ করা হলো। এই সংবাদটি গত রোববার (২১ জুলাই) ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দুই দিন ধরে রাজধানীজুড়ে বিক্ষোভ, সংঘাত, সহিংসতার মধ্যে গত শুক্রবার রাতে দেশজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়। তবে গতকাল শনিবারও রাজধানীর অন্তত চারটি স্থানে সড়ক অবরোধের চেষ্টা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে।
রাজধানীর যে চারটি স্থানে গতকাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়েছে, সেগুলো হলো যাত্রাবাড়ী ও শনির আখড়া এলাকা, উত্তরা, বাড্ডা ও মিরপুর। দু-তিন দিন ধরে রাজধানীর যে কটি স্থানে বেশি বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ হয়েছিল, তার মধ্যে এই চার এলাকা ছিল। গতকালের সংঘর্ষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫টি মরদেহ আসে।
আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী এলাকার পরিস্থিতি ছিল নাজুক। গতকালের আগপর্যন্ত টানা তিন দিন ধরে সেখানে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছিল। যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, কাজলা এলাকার সড়ক নিজেদের দখলে রেখেছিলেন বিক্ষোভকারীরা। গতকালও এই স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দিনভর থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়েছে। একপর্যায়ে অভিযানের মুখে গতকাল বিকেল পাঁচটার দিকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছেড়ে যান বিক্ষোভকারীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল সকাল সাতটা থেকে শনির আখড়া, কাজলা ও রায়েরবাগ এলাকায় মূল সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। দুপুর ১২টার দিকে রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে ছুড়তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এগোতে থাকেন। তখন পুরো এলাকা মুহুর্মুহু গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে। অভিযান শুরু হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেলিকপ্টার যাত্রাবাড়ী থানার ওপর দিয়ে রায়েরবাগ পর্যন্ত খুব নিচ দিয়ে বারবার প্রদক্ষিণ করতে থাকে। এ সময় সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলির শব্দ শোনা যায়। ছোড়া হয় কাঁদানে গ্যাসের শেল। বিপরীতে বিক্ষোভকারীরা শনির আখড়া, কাজলা ও রায়েরবাগে অবস্থান নিয়ে কয়েক জায়গায় সড়কে আগুন দেন। বিকেল পাঁচটার দিকে তাঁরা মূল সড়ক থেকে পিছু হটেন।
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কয়েকটি বাস ও পণ্যবাহী ট্রাক ঢাকায় ঢুকতে দেখা যায়। সন্ধ্যা সাতটায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে রায়েরবাগ পর্যন্ত এলাকায় অবস্থান নিয়েছিলেন। পাশাপাশি যাত্রাবাড়ী এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়ে আছেন। বিক্ষোভকারীরা মূল সড়কে না থাকলেও অলিগলিতে অবস্থান নিয়ে রয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মেরুল বাড্ডার বিভিন্ন এলাকায় জড়ো হন বিক্ষোভকারীরা। বেলা ১১টার দিকে প্রায় ৩০০ মানুষ বাড্ডার পোস্ট অফিস গলির সামনে মূল সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এতে তাঁরা পিছু হটেন। অনেকে আশপাশের অলিগলিতে ঢুকে যান। পুলিশ সরে এলে বিক্ষোভকারীরা আবার জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে শুরু করেন। দুপুর ১২টার দিকে রামপুরা থেকে সেনাবাহিনীর একটি টহল দল বাড্ডা এলাকায় আসে। গাড়িতে করে টহল দিয়ে তাঁরা আবার রামপুরার দিকে ফিরে যান। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মূল সড়কে পুলিশের কয়েক শ সদস্য অবস্থান নেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, বিক্ষোভকারীদের অনেকেই মেরুল বাড্ডার আবাসিক এলাকার ভেতরে অবস্থান নেন। তাঁদের কেউ কেউ মূল সড়কে আসার চেষ্টা করছিলেন। তখন তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। থেমে থেমে এই পরিস্থিতি চলছিল।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশের একটি দল কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। তাঁরা মাইকিং করে জনগণকে রাস্তায় বের না হওয়ার অনুরোধ করছেন। পুলিশ সদস্যরা মাইকে বলছিলেন, ‘কারফিউ জারি হয়েছে, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আপনারা কেউ ঘর থেকে বের হবেন না।’ তবে পুলিশের অনুরোধ উপেক্ষা করে পোস্ট অফিস গলির সামনে চলে আসেন বিক্ষোভকারীরা।
রাজধানীর উত্তরায় কয়েক দিন ধরে টানা বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হচ্ছে। গতকাল সকালেও বিক্ষোভকারীরা মূল সড়কে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থানের কারণে বিক্ষোভকারীরা মূল সড়কে উঠতে পারেননি। দিনভর উত্তরায় বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।
সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল থেকে উত্তরার অলিগলি থেকে কয়েক দফায় বিক্ষোভকারীরা অবরোধ করার জন্য মূল সড়কে ওঠার চেষ্টা করেন। তবে প্রতিবারই পুলিশ তাঁদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। এ সময় বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। উত্তরার আজমপুর ও হাউস বিল্ডিং এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্যের উপস্থিতি ছিল।
উত্তরার জমজম টাওয়ারের কাছে গতকাল রাত সাড়ে আটটার দিকে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ চলছিল। সেখানে হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়।
গতকাল সকাল থেকে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে সেনাবাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। গোলচত্বর হয়ে বিভিন্ন দিকে হেঁটে, রিকশায় কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাওয়া লোকজনকে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। বেলা পৌনে দুইটার দিকে প্রথমে গোলচত্বর থেকে উত্তর দিকে মিরপুর-১১ নম্বর সেকশনের দিকে সড়কে নেমে এক দল বিক্ষোভকারী আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। একই সময় গোলচত্বর থেকে দক্ষিণ দিকে কাজীপাড়া অংশেও বিক্ষোভকারীদের আরেকটি দল রাস্তায় নেমে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে।
এর একটু পর মিরপুর মডেল থানা থেকে সাঁজোয়া যানসহ পুলিশ সদস্যরা গোলচত্বরে এসে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে ধাওয়া দেন। এ সময় বিক্ষোভকারীরা মূল সড়ক থেকে সরে গিয়ে আশপাশের অলিগলিতে পালিয়ে যান।
বিকেল চারটার দিকে আবার আলোক হাসপাতালের সামনে অবস্থান নেন বিক্ষোভকারীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দুই দিক থেকে তাঁদের ধাওয়া দেন। একপর্যায়ে তাঁদের লাঠিপেটা করা হয়। এ সময় পাঁচজনকে আটক করে পুলিশ। এর কিছু সময় পর একজোট হয়ে বিক্ষোভকারীরা আবার রাস্তায় নামেন।
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মিরপুর-২ নম্বরের দিক থেকে সাঁজোয়া যান নিয়ে গোলচত্বরে আসেন পুলিশ সদস্যরা। প্রথমে তাঁরা সাঁজোয়া যান থেকে ফাঁকা গুলি করতে করতে কাজীপাড়ার দিকে থাকা বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। সাঁজোয়া যানটি ঘুরে ঘুরে তিনবার ওই দিকে গিয়ে লাগাতার ফাঁকা গুলি ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে।
উচ্চ আদালতের এক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ৫ জুন আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায় না হওয়ায় তাঁদের লাগাতার আন্দোলন শুরু হয় ১ জুলাই। শুরুতে এই আন্দোলন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমিত থাকলেও ক্রমে তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন ঠেকাতে বিভিন্ন জায়গায় হামলা-সংঘর্ষের পর একপর্যায়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণার পাশাপাশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গত বুধবার শিক্ষার্থীরা হল ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর ‘শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ-বিজিবি-র্যাব ও সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে’ গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ পালন করেন। এই কর্মসূচি ঘিরে টানা দুই দিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক সংঘর্ষে শতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সেনা মোতায়েন করা হয়।