দিনে সাড়ে ৩ ঘণ্টা বন্ধ রমনা পার্ক, তবে সবার জন্য নয়

স্কুলে সন্তানদের দিয়ে রমনা পার্কে অবসর সময় কাটাতে এসেছিলেন এই অভিভাবকেরা। কিন্তু পার্ক বন্ধ জানিয়ে তাঁদের ফিরিয়ে দেন ফটকে দায়িত্বরত আনসার সদস্য
ছবি: মোস্তফা মানিক

দিনের বেলায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয় ঢাকার রমনা পার্ক। ফটকে দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা এ সময়ে আসা লোকজনকে পার্কে ঢুকতে না দিয়ে ফিরিয়ে দেন। তবে সবার জন্য তাঁরা এ নিয়ম অনুসরণ করেন না। রমনা পার্ক দেখভালের দায়িত্বে থাকা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মী পরিচয় দিলে তাঁদের আর বাধা দেওয়া হয় না। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষেরা।

আজ শনিবার দুপুরে রমনা পার্কের হেয়ার রোডের ফটকে গিয়ে এমন ঘটনা দেখা যায়। পাশের ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সন্তানদের দিয়ে রমনা পার্কে অবসর সময় কাটাতে এসেছিলেন পাঁচ নারী অভিভাবক। তাঁরা পার্কে ঢুকতে চাইলে ফটকে দায়িত্বরত আনসার সদস্য বাধা দেন। ভেতরে যেতে হলে অনুমতি লাগবে জানিয়ে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে ১০ জনের পার্কে প্রবেশের অনুমতি আছে। তাঁরা ছাড়া অন্যদের ভেতরে যেতে দেওয়া হবে না।

নিরাপত্তাকর্মী আ. হান্নানের মুখে এ কথা শুনে অভিভাবকদের মধ্যে এক নারী বলেন, গণপূর্তে কাজ করেন ‘আহাদ ভাই’ তাঁর পরিচিত। তিনি পার্কের ফটকে এসে তাঁর কথা বলতে বলেছেন। জবাবে ওই আনসার সদস্য বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের সচিব স্যারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।’ পরে এই পাঁচ নারী পার্কের সামনের খোলা জায়গায় বসে সময় কাটান।

এ সময় আক্ষেপ করে শারমিন নাহার নামের তাঁদের একজন বলেন, ‘আইন তো সবার জন্য সমান। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেন আর কাউকে দিচ্ছেন না, এটা তো ঠিক হচ্ছে না। আরেক নারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঢুকতে না দিলে এটা রেখেছেন কেন? এটা তো জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত জায়গা। এসব না করে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেন তাহলে।’

আজ দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে সোয়া ১টা পর্যন্ত এই পাঁচ নারী ছাড়া আরও অনেকেই রমনা পার্কে ঢুকতে নিরাপত্তাকর্মীদের বাধার মুখে পড়েন। ওই সময় পার্কে প্রবেশ নিষেধ জানিয়ে তাঁদের বলা হয়, বেলা আড়াইটার দিকে পার্ক খুলে দেওয়া হবে। তবে গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মী পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিদের এ সময়ে পার্কে ঢুকতে দিতে দেখা যায়।

বেলা ১১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত রমনা পার্ক বন্ধ থাকলেও এ সময় ভেতরে কিছু মানুষকে দেখা যায়। ফটকে দায়িত্বরত আনসার সদস্য বলেন, আজ গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে ১০ জনকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল  

পার্কের এই ফটকের সামনে একটি বিজ্ঞপ্তি টাঙানো রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে, সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত এবং আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত পার্ক ব্যবহার করা যাবে। কবে এ বিজ্ঞপ্তি টাঙানো হয়েছে জানতে চাইলে আনসার সদস্য লুৎফর রহমান বলেন, কিছুদিন আগে টাঙানো হয়েছে।  

‘পার্ক বন্ধকালে সরকারি কর্মকর্তা, প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং যাঁদের সাথে পার্ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সম্পর্ক আছে, তাঁরা ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। এতে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। গণপরিসর নিয়ে এ ধরনের বৈষম্য তৈরি করার সুযোগ নেই।’
আদিল মুহাম্মদ খান, নগর-পরিকল্পনাবিদ

রমনা পার্কের আয়তন প্রায় ৬৮ দশমিক ৫ একর। লাগোয়া সব বহুতল ভবনের এই শহরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে ফাঁকা জায়গায় প্রাণ খুলে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য এই পার্ক বহু মানুষের কাছেই প্রথম পছন্দ। করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের মার্চে সাধারণ ছুটির সময় পার্কটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পরের বছর ২০২১ সালের ৩১ মে সাধারণ ছুটি তুলে নেওয়া হলেও পার্কটি খোলা হচ্ছিল না। এ নিয়ে হাইকোর্টে রিটও হয়। পরে এটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তবে মাঝে মাঝে বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে পার্ক বন্ধ রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আজ দুপুরে সরেজমিনে আরও দেখা যায়, আশপাশের এলাকা ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকেই রমনা পার্কে অবসর সময় কাটাতে এসে ফিরে গেছেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় দুপুরে নিজের প্রাইভেট কারে স্ত্রীকে নিয়ে আরামবাগ থেকে পার্কে এসেছিলেন সাইদুর রহমান। পার্কে ঢুকতে না পেরে তিনি ধানমন্ডি লেকের দিকে চলে যান। পুরান ঢাকার বংশাল থেকে মোটরসাইকেলে স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন আকবর হোসেন। আধঘণ্টা চেষ্টার পরও পার্কের ভেতরে প্রবেশ করতে না পেরে তিনি ফিরে যান।

পার্ক কেন বন্ধ রাখা হচ্ছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্কুলের শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রমনা পার্কে এসে সময় কাটায়। সেটা ঠেকানোর জন্যই দুপুর ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত পার্কে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।’

দিনের বেলা রমনা পার্ক বন্ধ রাখা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি এসেছে জানিয়ে সচিব বলেন, সে কারণে আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে এ বিষয়ে বৈঠক করবেন। ১ মার্চ থেকে সময়ের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে।

সাধারণ মানুষের চাওয়া, রমনা পার্কের ফটক যেন সারা দিন খোলা রাখা হয়

রমনা পার্ক বন্ধ রাখাকে নাগরিকদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য বাধা হিসেবে দেখছেন নগর-পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের এই অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় উন্মুক্ত জায়গার সংকট এতটাই তীব্র যে বিদ্যমান পার্কগুলো সার্বক্ষণিক খোলা রাখলেও তা পূরণ হওয়ার নয়। তালা মেরে রাখার কারণে সর্বজনীন অধিকারটা বিঘ্নিত হচ্ছে। ‌

আর পার্কে কাউকে কাউকে ঢুকতে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পার্ক বন্ধকালে সরকারি কর্মকর্তা, প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং যাঁদের সাথে পার্ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সম্পর্ক আছে, তাঁরা ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। এতে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। গণপরিসর নিয়ে এ ধরনের বৈষম্য তৈরি করার সুযোগ নেই।’
রমনা পার্ক সার্বক্ষণিক খোলা রাখার পরামর্শ দিয়ে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা শহরের মানুষের কল্যাণ চিন্তা করলে এর কোনো বিকল্প নেই।