আচরণবিধি ভঙ্গ করে রাজধানীর মোহাম্মদপুর-আদাবর এলাকায় নির্বাচনী ক্যাম্প। এতে হাঁটাচলা ও যানবাহন চলাচলে সমস্যা হচ্ছে।
আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ফুটপাত ও সড়কের জায়গা দখল করে মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির সামনের সড়কে নির্বাচনী ক্যাম্প করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর কবির নানক। বাঁশের খুঁটি ও কাপড় দিয়ে তৈরি করা এই ক্যাম্পের (অস্থায়ী কার্যালয়) ভেতরে ফুটপাতের জায়গায় রাখা হয়েছে টেবিল-চেয়ার। আর মূল সড়কের অংশে রাখা হয়েছে নেতা-কর্মীদের বসার জন্য কিছু চেয়ার। আছে সাউন্ডবক্সও (শব্দযন্ত্র)।
ওই ফুটপাতে এখন মানুষের হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে মূল সড়ক সংকুচিত হওয়ায় যানবাহন চলাচলেও সমস্যা হচ্ছে। নির্বাচনী এই ক্যাম্পে আলোকসজ্জারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যদিও নির্বাচনী ক্যাম্পে আলোকসজ্জা করার বিষয়টিও আচরণবিধির লঙ্ঘন।
এই ক্যাম্প ছাড়াও মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির সামনের সড়কে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নানকের নির্বাচনী ক্যাম্প রয়েছে আরও একটি। এর পুরোটাই মূল সড়কের ওপর করা হয়েছে। এই ক্যাম্পের আকারও ৪০০ বর্গফুটের বেশি।
এই নির্বাচনী ক্যাম্পের আকার ৮০০ বর্গফুটের বেশি। কিন্তু আচরণবিধি অনুযায়ী, ৪০০ বর্গফুটের বেশি কোনো ক্যাম্প করা যাবে না। গতকাল শুক্রবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ক্যাম্পের ভেতরে কেউ নেই। চেয়ার-টেবিল খালি পড়ে আছে। চারটি বড় সাউন্ডবক্স সড়কের ওপর রাখা। ক্যাম্পের ভেতরে আলো (টিউবলাইট) জ্বলছে। তবে নেতা-কর্মীরা কেউ নেই। ক্যাম্পের সামনে নানকের ছবিসহ বড় ব্যানার টাঙানো। আর ক্যাম্পের সামনে মূল সড়কের ওপর অসংখ্য পোস্টার টাঙানো।
এই ক্যাম্প ছাড়াও মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির সামনের সড়কে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নানকের নির্বাচনী ক্যাম্প রয়েছে আরও একটি। এর পুরোটাই মূল সড়কের ওপর করা হয়েছে। এই ক্যাম্পের আকারও ৪০০ বর্গফুটের বেশি।
মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির সামনের সড়কে স্থাপন করা দুটি ক্যাম্পের দূরত্ব ৩০ গজের কম। দুটোই একটি ওয়ার্ডে (ঢাকা উত্তর সিটির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড) করা হয়েছে। যদিও আচরণবিধি অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিটি ওয়ার্ডে একটির বেশি নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপনের কোনো সুযোগ নেই।
মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির সামনের প্রধান সড়কে যে দুটি অস্থায়ী নির্বাচনী ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে, তার একটি ব্যানারে লেখা ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের নির্বাচনী কার্যালয়।
ঢাকা-১৩ আসনের আওতাধীন সাতটি ওয়ার্ডের মধ্যে গতকাল দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত চার ঘণ্টায় মোটরসাইকেলে করে চারটি ওয়ার্ডের (৩০, ৩১, ৩২ ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড) বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। এর মধ্যে চারটি ওয়ার্ডে আটটি নির্বাচনী ক্যাম্প দেখা গেছে। যা হয় ফুটপাতের জায়গা দখল করে, না হয় সড়কের ওপর করা হয়েছে।
নির্বাচনী আচরণবিধি ভেঙে এই সংসদীয় আসনের বিভিন্ন এলাকায় গতকাল পিকআপ (ছোট ট্রাক) ও মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালানো হয়েছে। মাইক ব্যবহারের জন্য যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেটিও মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা-১৩ আসনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মোতাকাব্বীর আহমেদের সঙ্গে গতকাল সন্ধ্যা থেকে চার দফায় মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে এই আসনের আরেকজন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নজরুল ইসলামের মুঠোফোনে চার দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠানো হয় তাঁর মুঠোফোনে। তিনি এরপরও সাড়া দেননি। সবশেষ রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো; কিন্তু তিনিও ফোন ধরেননি।
জাকির হোসেন রোড থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গজনবী রোডে জেনেভা ক্যাম্প এলাকাতেও সড়ক-ফুটপাতের জায়গা দখল করে নির্বাচনী ক্যাম্প করা হয়েছে।
মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির সামনের প্রধান সড়কে যে দুটি অস্থায়ী নির্বাচনী ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে, তার একটি ব্যানারে লেখা ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের নির্বাচনী কার্যালয়।
মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডেও ফুটপাতে কাঠের তৈরি নৌকা বসিয়ে নির্বাচনী ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ফুটপাতে ক্যাম্প করায় মানুষ হাঁটাচলা করতে পারছে না। মোহাম্মপুরের জাকির হোসেন রোডেও একই চিত্র দেখা গেছে। সেখানে সিটি করপোরেশনের খেলার মাঠের পাশে হাঁটার জায়গা এবং পাশের ফুটপাতের কিছু অংশ দখল করে মোট দুটি ক্যাম্প করা হয়েছে।
হাঁটাচলার জায়গা বন্ধ করে নির্বাচনী ক্যাম্প করা ঠিক হয়নি, এসব নির্বাচন কমিশনের দেখা উচিত বলে মনে করেন মোহাম্মদপুর জাকির হোসেন রোডের একজন বাসিন্দা। তবে তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি।
জাকির হোসেন রোড থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গজনবী রোডে জেনেভা ক্যাম্প এলাকাতেও সড়ক-ফুটপাতের জায়গা দখল করে নির্বাচনী ক্যাম্প করা হয়েছে। জেনেভা ক্যাম্পের পাশে মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে আরেকটি ক্যাম্প করা হয়েছে। সেটিও তৈরি করা হয়েছে সড়ক ও ফুটপাতের জায়গায়। জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় নির্মিত দুটি ক্যাম্প ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলামের সৌজন্যে করা। দুটি ক্যাম্পের ভেতরে টাঙিয়ে রাখা ব্যানারে বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
জেনেভা ক্যাম্প থেকে দুই কিলোমিটার দূরে মোহাম্মদপুরের আদাবর রিং রোডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও মূল সড়কের ওপর নির্বাচনী ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। ৩০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই ক্যাম্প করা হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
গতকাল দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত যে আটটি ক্যাম্পে ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক, এর মধ্যে শুধু একটি ক্যাম্পে নেতা-কর্মীরা ছিলেন। ক্যাম্পে নেতা-কর্মীরা না থাকার কারণ হিসেবে দলীয় একটি সূত্র বলছে, গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় নেতা-কর্মীদের নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এই প্রচারে অর্ধশত পিকআপ ও মোটরসাইকেলের বহর ছিল।
নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, ট্রাক, বাস, মোটরসাইকেল, নৌযান, ট্রেন কিংবা অন্য কোনো যান্ত্রিক যানবাহন নিয়ে মিছিল বা শোডাউন (মহড়া) করা যায় না।
নাম না প্রকাশের শর্তে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর কবির নানকের নির্বাচনী প্রচারে থাকা এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, পিকআপ ও মোটরসাইকেলের বহন ছাড়া নির্বাচনী প্রচার জমে না। আর নির্বাচনী আচরণবিধিতে কী লেখা আছে, সেটি নেতা-কর্মীদের অনেকে জানে না।
নির্বাচনী আচরণবিধি ভেঙে প্রচারণা চালানোর বিষয়ে জানতে জাহাঙ্গীর কবির নানকের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর প্রধান সমন্বয়কারী (নির্বাচন পরিচালনা) নাজমুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটে থাকলে তাঁরা তা সংশোধন করে নেবেন। আর নির্বাচনী প্রচারে মোটরসাইকেল ও পিকআপ বহর ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নেতা-কর্মীরা অনেক সময় এসব নিয়ে চলে আসেন। এখন থেকে এ বিষয়গুলোও দেখা হবে। আচরণবিধি ভঙ্গ করতে চাই না আমরা।’
ঢাকা উত্তর সিটির সাতটি ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা-১৩ আসন গঠিত। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জাহাঙ্গীর কবির নানকের সঙ্গে এই আসনে আরও পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাঁরা হলেন বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের কামরুল আহসান (ফুলের মালা প্রতীক), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের জাফর ইকবাল (মোমবাতি), বিএনএফের জাহাঙ্গীর কামাল (টেলিভিশন), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের মো. শাহাবুদ্দিন (ছড়ি) এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির সোহেল সামাদ (একতারা)।
গতকাল এই আসনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর অসংখ্য পোস্টার চোখে পড়লেও বাকি প্রার্থীদের পোস্টার দেখা যায়নি।