‘ঢাকা কোষ’ বইতে বলা হয়েছে, আগা মসিহ আঠারো শতকের মাঝামাঝি ঢাকায় বসবাস করতেন। তিনি ছিলেন ঢাকার শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা। তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত জমিদার আগা বাকের।
পুরান ঢাকার সরু গলিগুলোর মোড়ের মাথায় প্রাচীন ঐতিহ্যের গরিমা আর আধুনিক স্থাপত্যের নান্দনিকতা ও বৈভব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আটতলা আগা মসিহ জামে মসজিদ। মসজিদটির দিকে তাকানোমাত্রই যে কেউ উপলব্ধি করবেন, এর আভিজাত্যই আলাদা।
পূর্ব দিকে মূল প্রবেশপথটি খিলান আকারের। সামনের দিকে প্রক্ষিপ্ত। রঙিন নকশা করা কাচের দরাজ ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। ভেতরের মার্বেল পাথরের ফলকে খচিত পবিত্র কোরআনের আয়াত, ফুল-লতাপাতার নকশা করা কাচের ফলক, সোনালি, রুপালি,বাদামিসহ বিভিন্ন রঙের নকশা খচিত চকচকে টাইলস, কারুকাজ খচিত প্রধান মিহরাবের দুই পাশে রঙিন কাচ ও গ্রানাইট পাথরে তৈরি মিনার, সেগুন কাঠের নকশা করা দরজার ছোট মিহরাব, ছাদের ঝাড়বাতি মিলিয়ে বর্ণাঢ্য পরিবেশ।
আগা মসিহ লেনের মসজিদে দুটি মিনার রয়েছে। মিনার দুটির উচ্চতা প্রায় দেড় শ ফুট। মিনারের ভেতরে লাগানো হয়েছে রঙিন বাতি। সন্ধ্যার পর বাতিগুলো জ্বলে উঠলে অপরূপ সুন্দর দেখায় মিনারের শোভা।
মসজিদের বাইরের দেয়ালের টাইলসে নিখুঁত নকশা। মসজিদটির পশ্চিম দিকে আবাসিক বাড়িঘর। পথের মোড়ে অবস্থিত বলে উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিক খোলা। ভেতরে প্রচুর আলো–বাতাস প্রবেশের জন্য এ তিন দিকের দেয়ালে স্তরে স্তরে সারবদ্ধভাবে খিলান আকৃতির জানালা করা হয়েছে। জানালায় বসানো হয়েছে ফুল–লতাপাতার নকশা করা লোহার গ্রিল।
আগা মসিহ লেন মসজিদের দৃশ্য বরাবর এমন ছিল না। এখানে ছিল তিন গম্বুজবিশিষ্ট মোগল স্থাপত্য রীতির একটি একতলা মসজিদ। এর সঠিক নির্মাণকাল জানা যায় না। নির্মাতা কে ছিলেন, তা–ও স্পষ্ট নয়। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক হাসান দানী মন্তব্য করেছেন, মসজিদটি ঊনবিংশ শতকে নির্মিত বলে তাঁর ধারণা। ‘কালের সাক্ষী: ঢাকা’ বইয়ে দানী উল্লেখ করেছেন, চার লেনের সংযোগস্থলে মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদে প্রবেশের জন্য দরজা ছিল তিনটি। প্রতিটি দরজার পরপর দুটি করে স্তম্ভ ছিল। আর ভবনটি ছিল বাংলো আকৃতির। তাঁর মতে, উত্তর ভারতের অট্টালিকাগুলোর মতো ধাঁচ ছিল আগা মসিহ লেন মসজিদের।
মসজিদটি আগা মসিহ নির্মাণ করেছিলেন—এমন কোনো তথ্য ইতিহাসবিদেরা দেননি। তবে এই এলাকার নামকরণ হয়েছে আগা মসিহের নামে। হতে পারে এলাকার নামের কারণেই মসজিদটির এমন নাম হয়েছে।
অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত এশিয়াটিক সোসাইটির ‘ঢাকা কোষ’ বইতে বলা হয়েছে, আগা মসিহ আঠারো শতকের মাঝামাঝি ঢাকায় বসবাস করতেন। তিনি ছিলেন ঢাকার শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা। তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত জমিদার আগা বাকের। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, আগা বাকের ছিলেন আর্মেনীয়। পরে ইসলামের শিয়া মতাবলম্বী হন।
বরিশালে আগা বাকেরের জমিদারি ছিল। বাকেরগঞ্জ জেলা তাঁর নামেই নাককরণ করা হয়েছে। ঢাকার বিখ্যাত ‘বাখরখানির’ উদ্ভাবক ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও তিনি স্মরণীয়। তাঁর দুই পুত্র আগা সাদেক ও আগা মসিহ। আগা বাকের ও আগা সাদেক ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার অনুসারী। তাঁরা একপর্যায়ে মুর্শিদাবাদকেন্দ্রিক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েন। নানা ঘটনার পরম্পরায় তাঁরা দুজনেই নির্মমভাবে নিহত হন।
আগা মসিহের জামিদারির বিষয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। একসময় নবাব সরকারের রাজস্ব বিভাগেও চাকরি করেছেন। ঢাকার ইতিহাসবিদ সৈয়দ মোহাম্মদ তাইফুর ‘গ্লিমসেস অব ওল্ড ঢাকা’ বইতে উল্লেখ করেছেন, আগা সাদেকের বাড়ির পাশেই আগা মসিহের বাড়ি ছিল। বিশ শতকেও তিনি জরাজীর্ণ বাড়িটি দেখেছেন। এই বাড়ির পাশের সড়কটিই এখন আগা মসিহ লেন নামে পরিচিত।
পাকিস্তান আমলে আগা মসিহ লেনে একটি আইন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ‘সিটি ল কলেজ’ নামের এই আইন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লাল ইটের পুরোনো ভবনটি এখনো টিকে আছে। তার বিপরীত দিকেই আগা মসিহ লেন মসজিদের বৈভবময় নতুন ভবন।
রোববার দুপুরে কথা হয় মসজিদের খতিব মাওলানা মুফতি কামাল উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, পুরোনো মসজিদটি ২০১৩ সালে ভেঙে নতুন মসজিদ তৈরির কাজ শুরু হয়। প্রথম দফায় তিনতলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালের আটতলা পর্যন্ত সব কাজ সম্পন্ন করা হয়। প্রতিটি তলায় নামাজের জায়গা আছে সাড়ে চার হাজার বর্গফুট। মসজিদের মোট জায়গা ছয় কাঠার কিছু বেশি। একসঙ্গে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে পবিত্র জুমার দিন বিশেষ করে রমজান মাসে মসজিদের ছাদে, সামনের সড়কেও নামাজ হয়। সেখানে অতিরিক্ত প্রায় দুই হাজার মুসল্লি নামাজে অংশ নেন।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুল বারেক এবং স্থানীয় মুসল্লিদের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা জানালেন, পুরোনো মসজিদটি এত জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল যে সংস্কারের উপযোগী ছিল না। তা ছাড়া এলাকায় জনসংখ্যা এখন অনেক বেশি। একতলা মসজিদটিতে স্থান–সংকুলান হচ্ছিল না। অনিবার্য প্রয়োজনে পুরোনো মসজিদের জায়গায় নতুন করে এই মসজিদ করা হয়েছে। এলাকার মুসল্লিরা মসজিদটি নির্মাণের সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করেছেন। তাঁরা চেষ্টা করেছেন এমন করে মসজিদটি নির্মাণ করতে, যেন আগা মসিহ লেন মসজিদের ঐতিহ্য ম্লান না হয়। সে কারণে পুরোনো মলিন মসজিদের জায়গায় দ্যুতিময় হয়ে আছে মসজিদটির নতুন ভবন।