‘ধর্মীয় সম্প্রীতি-বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা, ২৬ অক্টোবর
‘ধর্মীয় সম্প্রীতি-বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা, ২৬ অক্টোবর

দেশে ধর্মীয় সংহতি বজায় থাকলে সংঘাত কমবে

রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে হানাহানি–সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। দেশে যার যার ধর্ম পালনে সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে হবে। পরিবার থেকেই অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখাতে হবে। ধর্মীয় সংহতি বজায় থাকলে দেশে সংঘাত কমে আসবে।

‘ধর্মীয় সম্প্রীতি-বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে এ কথা উঠে আসে। রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে আজ শনিবার এই সংলাপের আয়োজন করে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট ও মাল্টিস্টেকহোল্ডার ইনিশিয়েটিভ ফর পিস অ্যান্ড স্ট্যাবিলিটি (এমআইপিএস)। অনুষ্ঠানে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

সংলাপে জানানো হয়, দেশের ৩০টি জেলার ৮০টি উপজেলা এমআইপিএস কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে। ৫ বছর মেয়াদের এই প্রকল্প শুরু হয় ২০২৩ সালে। সম্মিলিত উদ্যোগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও জাতিগত সহিংসতার ঘটনা চিহ্নিত, প্রতিরোধ, প্রশমন ও নিষ্ক্রিয় করার মাধ্যমে সহনশীলতা বাড়ানো এবং সবার মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি জোরদার করা এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য।

ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর সবাই যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে, তার জন্য সব ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। প্রত্যেকের রাজনৈতিক–সাংস্কৃতিক অধিকার যেমন আছে, তেমনি ধর্মচর্চার অধিকার আছে। যারা উপাসনালয়ে হামলা চালায়, তাদের কোনো ধর্মীয় পরিচয় নেই, তারা দুর্বৃত্ত। ধর্মচর্চায় কাউকে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, ধর্ম পালনে কেউ যেন বাধা নিতে না পারে, সে জন্য সরকার সতর্ক রয়েছে। ধর্মীয় সংহতি বজায় থাকলে সংঘাত কমে আসবে।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা ও স্বাগত বক্তব্য দেন দি হাঙ্গার প্রজেক্টের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে সম্প্রীতির শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে সম্মিলিত প্রচেষ্টা নিতে হবে। রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ থেকে হানাহানি করা হচ্ছে। রাজনীতি, ধর্ম ও জাতিগত ভিন্নতা থাকতে পারে। এই ভিন্নতা নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে না পারলে কেউই নিরাপদ থাকতে পারবে না। সবার মধ্যে এই উপলব্ধি তৈরি করতে হবে।

সংলাপে বক্তব্য দেন দি হাঙ্গার প্রজেক্টের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর বদিউল আলম মজুমদার। ঢাকা, ২৬ অক্টোবর

সংলাপে ‘বাংলাদেশের ধর্ম ও সংস্কৃতি: ঐতিহ্য, সংকট ও করণীয়’ শিরোনামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মামুন আল মোস্তফা। প্রবন্ধে বলা হয়, এই মুহূর্তে পৃথিবীতে যত লোক ধর্মের নামে ঘৃণা ছড়াচ্ছে, সন্ত্রাস করছে; তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ ধর্মের নামে মানবতার কল্যাণে নিজেদের অর্থ ও শ্রম দিচ্ছে। কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এ বিষয়ে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে উন্নতির দিকে যাওয়া সম্ভব। এ জন্য ‘নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ে অন্যান্য ধর্মের মৌলিক কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে একটি অধ্যায় সন্নিবেশ করা যেতে পারে।

মুক্ত আলোচনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক মুহাম্মদ রফিক-উল ইসলাম বলেন, সুদীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য রয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় পবিত্র কোরআন অবমাননা ও মন্দিরে আগুন দিয়ে ঘটনা সাজানো হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, ব্যক্তিস্বার্থে সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিষয় সামনে আনা হয়।

বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয় ধর্ম নিয়ে হানাহানি না করে মানবতাবোধকে জাগ্রত করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এ দেশে আমরা সকলে মানুষ। আমরা এক জাতি। আমাদের ভাষা এক। ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়।’

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্মের কাউকে নেওয়া হয়নি উল্লেখ করে আক্ষেপ করেন হাউস চার্চ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান রেভারেঞ্জ জেমস জিপু রায়। তিনি বলেন, প্রত্যেকের কাছে তাঁর নিজের ধর্ম শ্রেষ্ঠ। অনুষ্ঠান শুরুর আগেও কয়েকজনের কথায় তিনি শুনেছেন অন্য ধর্মের লোকজনকে ‘বিধর্মী’ বলা হয়েছে। ধর্মীয় সম্প্রীতির বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও গণমাধ্যম কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, সেই প্রশ্ন রয়েছে।

অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে ‘এজেন্টস অব চেঞ্জ: এ বাংলাদেশ ফ্রিডম অব রিলিজিওন অর বিলিফ লিডারশিপ ইনিশিয়েটিভ প্রজেক্ট’–এর কর্মসূচি উপদেষ্টা শাহনাজ করীম বলেন, সবখানে নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। ধর্মকে আঘাত করা সহজ। এ কারণে ধর্মের অপব্যবহার হয় বারবার।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক মাওলানা জুবায়ের আহমেদ মূল প্রবন্ধে ‘ধর্মবাদী ও প্রগতিবাদী’ শব্দ ব্যবহার নিয়ে আপত্তি করেন। তিনি বলেন, ‘প্রগতিবাদী’ শব্দ ব্যবহার করে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়। ইসলাম শ্রেষ্ঠ ধর্ম। ধর্মের নামে ভুল কিছু নয়, যথাযথ জ্ঞানভিত্তিক বার্তা ছড়ানো উচিত তৃণমূল পর্যায়ে।

এ সময় আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতির সভাপতি হীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস ও টালিথাকুমি চার্চের বিশপ ফিলিপ পি অধিকারী।

অনুষ্ঠানে এমআইপিএস প্রকল্পের বিষয়ে তথ্য উপস্থাপন করেন প্রকল্পের উপকর্মসূচি পরিচালক নাজমুন নাহার নূর।