ঋণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ জায়গায় ঢাকা দ্রুতগতির উড়ালসড়কের (ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেছে।
গত মঙ্গলবার নির্মাণকাজের পাঁচটি জায়গা (ওয়ার্ক স্টেশন-স্টকইয়ার্ড) ঘুরে দেখা গেছে, হাতিরঝিল ছাড়া আর কোথাও কাজ চলছে না। হাতিরঝিলেও সীমিতসংখ্যক জনবল নিয়ে কাজ চলছে। বাকি চারটি জায়গায় (কাওলা, মগবাজার, মালিবাগ ও কমলাপুর) অল্পসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রিসহ কিছু কর্মী রাখা হয়েছে।
কর্মীদের ভাষ্য, কোথাও এক মাস ধরে কাজ বন্ধ, কোথাও দুই মাস।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই মাসে অন্তত ৮০ শতাংশ কর্মীকে বিনা বেতনে ছুটিতে পাঠিয়েছে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান।
অর্থসংকটে বেশির ভাগ জায়গায় কাজ বন্ধ থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে নির্মাণ ও পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (এফডিইই) কোম্পানি লিমিটেড। প্রথম আলোর এক ই–মেইলের জবাবে ৩ এপ্রিল এফডিইইর পক্ষ থেকে বলা হয়, কাজ চালু রাখার জন্য ঋণ পেতে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোম্পানির কাজ চলছে।
অবশ্য প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতার হাতিরঝিলের প্রসঙ্গ টেনে প্রথম আলোকে বলেন, কাজ বন্ধ নেই। কাজ চলছে। তবে ঋণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পের কাজ শেষ করতে এক বছর বেশি সময় লাগতে পারে।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে রেললাইন ধরে তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে এই উড়ালসড়ক। পুরো উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) বড় এই প্রকল্পে বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ডের একটি ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ এবং নির্মাণকাজের মাধ্যমে অংশীদার। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো থাইল্যান্ডভিত্তিক ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড, চীনের শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড।
এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য এফডিইই কোম্পানি লিমিটেড নামের কোম্পানি গঠন করে ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট। কোম্পানির অংশীদার তিন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার যথাক্রমে ৫১, ৩৪ ও ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ হলো এক্সপ্রেসওয়ের নির্বাহক প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্পের মূল নির্মাণকাজে ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। চুক্তি অনুসারে, মূল কাঠামো নির্মাণব্যয়ের ৭৩ শতাংশ জোগান দেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। আর ২৭ শতাংশ দেবে বাংলাদেশ সরকার, যা ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং (ভিজিএফ) নামে পরিচিত।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঋণ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকেও প্রকল্পের নির্মাণকাজ ব্যাহত হচ্ছে।
এফডিইইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাই নাগরিক ভাস্কন খান্নাভা গত ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর কার্যালয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, চলতি বছরের ৩০ মার্চের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হবে না জেনে গত ১৭ জানুয়ারি ঋণ আটকে দিয়েছে চীনের দুটি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান চায়না এক্সিম ব্যাংক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না (আইসিবিসি)।
চীনের ব্যাংক দুটি সঙ্গে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ চুক্তি করেছিল বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ঋণকে কেন্দ্র করে তিনটি অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকার বিষয়টিও তখন স্বীকার করেছিলেন খান্নাভা।
২০০৯ সালে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ২০১১ সালে নির্মাণের চুক্তি হয়। নির্মাণকাল ধরা ছিল সাড়ে তিন বছর। তবে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়নি। আনুষ্ঠানিক নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি।
গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার দূরত্ব অংশ উদ্বোধন করা হয়। পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর এই অংশে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। গত ২০ মার্চ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) গেট-সংলগ্ন র্যাম্প যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা।
গত মঙ্গলবার বিমানবন্দরের কাছের কাওলা ইয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, পরিমল নামের এক নিরাপত্তাকর্মী বসে আছেন। সেখানে কোনো কাজ হচ্ছে না। আগে এখানে এক্সপ্রেসওয়ের পিলারের (স্তম্ভ) ওপর বসানোর জন্য গার্ডার বানানো হতো।
কাওলায় রেললাইনের এক প্রান্তে গিয়ে দেখা গেল, ইয়ার্ডে সারি সারি করে ক্রেন রাখা। আশপাশের লোকজন জানালেন, ইয়ার্ডে কাজ এখন বন্ধ। নিরাপত্তাকর্মী পরিমলের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই মাস ধরে কাজ বন্ধ আছে।
মগবাজার ইয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ৮-১০ কর্মী আছেন। ওসমান, পাখি, শামীম নামের তিনজন কর্মী জানান, তাঁরা এক শর ওপর কর্মী ছিলেন। বাকিরা ছুটিতে আছেন। মাসখানেক ধরে কাজ বন্ধ রয়েছে।
এলাকাটির ইসলাম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক চান মিয়া ও মুদিদোকানি মো. আবুল কাশেম বললেন, এক মাসের বেশি সময় ধরে এখানে কোনো কাজ দেখছেন না তাঁরা।
মালিবাগ থেকে খিলগাঁও ফ্লাইওভার পর্যন্ত দেখা যায়, টিনের বেড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে কোনো কাজ চলছে না। কোনো নিরাপত্তাকর্মীকেও সেখানে দেখা যায়নি।
কমলাপুরের টিটিপাড়া ইয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, অল্প কিছু কর্মী ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বড় ফাঁকা জায়গায় মালামালের স্তূপ। ঢালাই তৈরির জন্য বড় প্ল্যান্ট বসানো। সেখানে কোনো কাজ হচ্ছে না।
এই ইয়ার্ডে আগে গার্ডার তৈরি করা হতো। কথা বলতে চাইলে ইয়ার্ডের বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি সেলিম রেজা এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন, এক মাস ধরে কাজ বন্ধ আছে। কর্মীরা ছুটিতে আছেন। এখন গার্ডার তৈরি হচ্ছে না।
এক প্রশ্নের জবাবে সেলিম বলেন, এখানে দুই শতাধিক কর্মী ছিলেন। এখন ১০ জনের মতো আছেন।
কমলাপুরের টিটিপাড়া ইয়ার্ড-সংলগ্ন লাল-সবুজ বাস পরিবহন কোম্পানির লাইনম্যান মো. মোবারক বলেন, এক মাস ধরে এখানে কোনো কাজ হতে দেখেননি তিনি।
কমলাপুর রেলস্টেশনের কাছের ওয়ার্কস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, কোনো কাজ চলছে না। লোকজন ফটক দিয়ে ঢুকে রেলওয়ে কলোনি ও স্টেশনের দিকে যাতায়াত করছেন।
পরে শাহরিয়ার নামে একজন বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি বেরিয়ে এসে বলেন, নিরাপত্তাকর্মী আশপাশেই আছেন। এক মাস ধরে এখানে কাজ বন্ধ।
তবে হাতিরঝিল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কর্মীরা কাজ করছেন। এক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তেজগাঁও ওয়ার্ক স্টেশন বন্ধ করে সেখানের কর্মীদের দিয়ে হাতিরঝিলে কাজ করা হচ্ছে।
মেহেদি হাসান নামের ওই কর্মী বলেন, তিনি আগে তেজগাঁও ওয়ার্ক স্টেশনে কাজ করতেন। তাঁরা ৭০ জনের মতো ছিলেন। সেখান থেকে ৪০ জনকে হাতিরঝিলের কাজে লাগিয়ে বাকিদের ছুটি দেওয়া হয়েছে। সকাল ছয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত হাতিরঝিলে কাজ চলে। তিনি রডের খাঁচা বানানোর কাজ করেন।
ছুটি দেওয়া প্রসঙ্গে বেশ কয়েকজন কর্মী বলেন, বলা হয়েছে, কোম্পানির অবস্থা ভালো না। পরে কাজ শুরু হলে আবার ডাকা হবে।
ছুটি পাওয়া কর্মীদের একজন মো. ইব্রাহিম (৩০) প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ১০ মাস কাজ করেছিলেন। গত ২১ মার্চ তাঁকে ছুটি দেওয়া হয়। শুরুতে তেজগাঁও ওয়ার্ক স্টেশনে রড বাঁধাই করার কাজ করতেন তিনি। তখন মাসে ১৮ হাজার টাকার বেশি বেতন পেতেন। ওভারটাইমসহ মাসে আসত ২৬-২৭ হাজার টাকা। পাঁচ মাস পর তাঁকে একই বেতনে মগবাজারে সিগন্যালম্যান করা হয়। পরে কম বেতনে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ পান তিনি।
প্রথম আলোর এক ই–মেইলের জবাবে এফডিইইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান্নাভা বলেন, ‘কাজের গতি কমে গেছে, আপনি ঠিকই লক্ষ করেছেন। প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য স্বল্পমেয়াদে অন্তর্বর্তী ঋণ এবং প্রকল্পের জন্য ঋণ পেতে আমরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করছি। অর্থসংক্রান্ত কাজ এখন ধীরে চলছে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশে এখন রমজান। আর শরৎ উৎসব ও ইস্টার সানডের কারণে হংকংয়ের বাজার এই সপ্তাহ পর্যন্ত বন্ধ। আগামী সপ্তাহে এই কাজে গতি আসবে।’
ফেব্রুয়ারিতে খান্নাভার কার্যালয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি ই–মেইলে লিখেছেন, ‘স্বল্প মেয়াদের ঋণ দিয়ে নির্মাণকাজ চালিয়ে রাখতে পারব আমরা। ধীরগতি থাকলেও প্রকল্প ঋণের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাওয়া যাবে, যা আপনাকে আগেও বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এ বছরের জুন মাসের মধ্যে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করার আশা করা যায়।’
প্রকল্পের পরিচালক সাখাওয়াত আখতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুনেছি, লোন হোল্ড (ঋণ স্থগিত) হয়ে আছে। ঋণের জন্য তারা (বিনিয়োগকারীরা) বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বলে শুনেছি। সেই কাজ এগোচ্ছে। ঋণের ইস্যুটি আমাদের বিষয় নয়। সেটা তারা (বিনিয়োগকারীরা) বুঝবে। তাদের পার্টনার-পার্টনার (অংশীদার) গন্ডগোল আছে। কেস-কাছারি চলছে। সেটাও আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা স্পষ্ট বলেছি, সময়মতো কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে। পক্ষগুলো সচিবের সঙ্গে দেখা করেছে। তারা অঙ্গীকার করেছে, কাজ চালিয়ে যাবে। লোন না পাওয়া পর্যন্ত ইক্যুইটি (বিনিয়োগকৃত অর্থ) থেকে তারা কাজ চালিয়ে যাবে বলেছে।’
স্থানের নাম উল্লেখ করে নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে জানানোর পর প্রকল্প পরিচালক বলেন, কাজ বন্ধ নেই। কাওলার স্টকইয়ার্ডে আর গার্ডার তৈরি না করতে বলা হয়েছে। সেটা বিমানবন্দরের টার্মিনালের কাজের জন্য রাখার কথা বলা হয়েছে।
কমলাপুর ও মালিবাগ স্টকইয়ার্ড প্রসঙ্গে সাখাওয়াত আখতার বলেন, সেখানে কিছু সময়ের জন্য হয়তো কাজ বন্ধ আছে। হাতিরঝিলে তো কাজ চলছে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাওলার স্টকইয়ার্ডটি বিনিয়োগকারীদের হাতেই রয়েছে। অর্থসংকটে সেখানে কাজ বন্ধ রয়েছে।