খাল থেকে নৌকায় করে যাওয়া যাবে নদীতে—বিভিন্ন সময় এমন স্বপ্নের কথা বলেছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ঢাকা উত্তরের চারটি খাল এখন হেঁটেই পার হওয়া যায়। আবর্জনার স্তূপ জমে আরও চারটি খালে পানিপ্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
মেয়র কয়েক দফা উদ্যোগী হয়ে গত বছর এসব খাল সংস্কার করেছিলেন। তখন খালে পানির প্রবাহ ফিরেছিল। কিন্তু পরে আর তদারকির কাজটি ঠিকমতো হয়নি। এর ফল হচ্ছে খালে পানিপ্রবাহের বদলে আবর্জনার স্তূপ জমেছে। রূপনগর খালপাড়ের বাসিন্দা আবু সিয়াম খান বললেন, খালের ময়লা-আবর্জনা এখনই পরিষ্কার করার কাজ শুরু না করলে বর্ষার সময় ভুগতে হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি এলাকায় ছোট–বড় মিলিয়ে খাল আছে ২৯টি। এ ছাড়া একটি জলাধারও (কল্যাণপুর) রয়েছে। চলতি মার্চ মাসের ১২, ১৩ ও ১৪ তারিখ প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক ১৩টি খাল ও একটি জলাধার এলাকা ঘুরে দেখেছেন। এর মধ্যে চারটি খালের বেশির ভাগ অংশ এখন হেঁটেই পার হতে পার হওয়া যায়। এই চার খাল হলো রূপনগর খাল, দ্বিগুণ খাল (পল্লবীর ইস্টার্ন হাউজিং), সাংবাদিক কলোনি খাল (পল্লবী) ও কল্যাণপুর মূল খাল (গাবতলী)।
খাল পরিষ্কারের জন্য সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম অনেকটাই অভিযানকেন্দ্রিক। কাজটি যে ধারাবাহিক তদারকির মাধ্যমে করে যেতে হয়, সেই পরিকল্পনা আসলে তাদের নেই।নগর–পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহম্মদ খান
আবর্জনার স্তূপ জমেছে কাটাসুর, রামচন্দ্রপুর এবং কল্যাণপুর ক ও চ—এই চার খালে। অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় রয়েছে অর্থাৎ কিছুটা হলেও পানিপ্রবাহ রয়েছে পাঁচটি খালে। এই পাঁচ খাল হলো—গোদাখালী খাল, প্যারিস রোড খাল, বাউনিয়া খাল, ইব্রাহিমপুর খাল ও কল্যাণপুর খ খালে। অবশ্য এসব খালের পানি কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত। এর বাইরে কল্যাণপুর জলাধারের প্রায় পুরোটা কচুরিপানায় ঢাকা।
আগামী বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টি হলে ঢাকা উত্তর সিটির বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নগর–পরিকল্পনাবিদেরা। তাঁরা বলছেন, একসময় ভারী বৃষ্টি হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা বেশি হতো। তবে এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। ঢাকা উত্তরের বেশ কিছু এলাকায় এখন ভারী বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হচ্ছে।
গত দুই বছরে বর্ষার সময় জলাবদ্ধতা হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটির আওতাধীন ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, কল্যাণপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, মিরপুর, রূপনগর, খিলক্ষেত, নর্দ্দা ও বাড্ডা এলাকায়। ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবরে ভারী বৃষ্টির পর মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খালের পানি উপচে বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়েছিল। তখন মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড, নবোদয় হাউজিং, মোহাম্মদীয়া হোমসসহ আশপাশের বস্তি এলাকায় ব্যাপক জলাবদ্ধতা হয়। খালের ওপরে থাকা সেতুতেও তখন হাঁটুপানি জমেছিল। দুদিন পানিবন্দী ছিলেন গাবতলী সিটি কলোনির পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।
এ ছাড়া গত বছরের ৩০ জুন ৮৭ মিলিমিটার বৃষ্টিতে মিরপুর ১৪ নম্বর থেকে ১০ নম্বরে যাওয়ার সড়কটি পানিতে তলিয়ে যায়। সেদিন কাজীপাড়া থেকে শেওড়াপাড়া যাওয়ার সড়কও ছিল পানির নিচে। ওই বছরের ৭ অক্টোবর ভারী বৃষ্টির পর জলাবদ্ধতা হয়েছিল কারওয়ান বাজার, গ্রিনরোডসহ ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকায়।
একসময় ভারী বৃষ্টি হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা বেশি হতো। তবে এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। ঢাকা উত্তরের বেশ কিছু এলাকায় এখন ভারী বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হচ্ছে।
মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, আগারগাঁও ও মিরপুরের বিভিন্ন এলাকার বৃষ্টির পানি রামচন্দ্রপুর ও কল্যাণপুর মূল খাল হয়ে কল্যাণপুর জলাধারে যায়। সেখান থেকে সেচযন্ত্রের মাধ্যমে পানি বুড়িগঙ্গা নদীতে অপসারণ করা হয়। ১৫ মার্চ ওই জলাধারে গিয়ে দেখা যায় পুরোটা কচুরিপানায় ঢাকা।
ওই জলাধারের সঙ্গে মিশেছে কল্যাণপুর মূল খাল। যার দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪৬ কিলোমিটার, প্রস্থ ১৮ থেকে ৩৬ ফুট। কল্যাণপুর এলাকা থেকে এ খালের শুরু। খালটি যে অংশে জলাধারে গিয়ে মিশেছে, সে অংশ এখন আবর্জনায় ভরা। জমাটবাঁধা আবর্জনার ওপর দিয়ে রীতিমতো হাঁটা যায়। মাথায় ঘাসভর্তি বস্তা নিয়ে দুই কিশোরকে ১৫ মার্চ দুপুরে হেঁটে খাল পার হতে দেখা যায়।
কল্যাণপুর মূল খালের মতো রূপনগর খালেরও এখন একই অবস্থা। ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাল পল্লবীর ইস্টার্ন হাউজিং আবাসিক এলাকায় ‘দ্বিগুণ খালের’ সঙ্গে মিশেছে।
রূপনগর টিনশেড আবাসিক এলাকায় খালের পুরোটাই এখন আবর্জনায় ভরা। রূপনগর খাল যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকেই দ্বিগুণ খালের শুরু। আবর্জনা জমে এই খাল প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। একই দশা মিরপুরের কালশীর সাংবাদিক কলোনি খালেরও। খালপাড়ের বাসিন্দা সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, গত বর্ষার পর এই খাল আর পরিষ্কার করা হয়নি। লোকজনও খালের ময়লা ফেলে। সিটি করপোরেশনের তদারকি নেই।
মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, আগারগাঁও ও মিরপুরের বিভিন্ন এলাকার বৃষ্টির পানি রামচন্দ্রপুর ও কল্যাণপুর মূল খাল হয়ে কল্যাণপুর জলাধারে যায়। সেখান থেকে সেচযন্ত্রের মাধ্যমে পানি বুড়িগঙ্গা নদীতে অপসারণ করা হয়। ১৫ মার্চ ওই জলাধারে গিয়ে দেখা যায় পুরোটা কচুরিপানায় ঢাকা।
এ ছাড়া মোহাম্মদপুর এলাকার কাটাসুর খাল, কল্যাণপুর চ-খালে (রাজস্ব ভবনের পেছনের অংশ), কল্যাণপুর ক খালেরও বেশির ভাগ অংশে আবর্জনা জমে থাকতে দেখা গেছে। তবে গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্যারিস রোড খাল (মিরপুর ১১ নম্বরে) থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করেছে সিটি করপোরেশন। যে কারণে এই খালে এখন পানিপ্রবাহ আছে। আর গত বছর বাউনিয়া খাল (মিরপুর ১৪ নম্বরে) এবং ইব্রাহিমপুর খাল সংস্কারের কাজ হয়েছে। এই দুই খালেও পানির প্রবাহ আছে। তবে পানি কালো, নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত।
খাল পরিষ্কার রাখার কাজটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের মনোভাব হয়ে গেছে সিটি করপোরেশন সবকিছু করে দেবে। এ কারণে খাল একবার পরিষ্কার করার পরে আবার আবর্জনায় ভরে যায়। সিটি করপোরেশনের পক্ষে এক-দুবার হয়তো পরিষ্কার করে দেওয়া সম্ভব, এর পরে কিন্তু এলাকাবাসীকেই খাল আবর্জনামুক্ত রাখার দায়িত্ব নিতে হবে। সবাই এগিয়ে না এলে কোনো কিছুই টেকসই হবে না।
মোহাম্মদপুর এলাকার কাটাসুর খাল, কল্যাণপুর চ-খালে (রাজস্ব ভবনের পেছনের অংশ), কল্যাণপুর ক খালেরও বেশির ভাগ অংশে আবর্জনা জমে থাকতে দেখা গেছে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর গত জুন পর্যন্ত ২৯টি খাল ও ১টি জলাধার সংস্কারে ৬১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা খরচ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ। খাল ও নালা মেরামত, খাল পরিষ্কার ও উন্নয়ন এবং সীমানা নির্ধারণ বাবদ এ টাকা খরচ করা হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের বাজেট বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সিটি করপোরেশন। ২০২১-২২ অর্থবছরে খরচ করে আরও ১২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে খাল সংস্কার ও উন্নয়নে ২২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। চলতি অর্থবছরে খাল রক্ষণাবেক্ষণে আরও ৫৩ কোটি বরাদ্দ রেখেছে সিটি করপোরেশন।
এর বাইরে সীমানা চিহ্নিত করার মাধ্যমে অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে খাল উদ্ধারে ২৭ কোটি টাকায় আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ ওই বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে আরও দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নেওয়া হয়। কিন্তু এরপরও সময়মতো কাজ শেষ হয়নি। এখন প্রকল্পের মেয়াদ আরও ছয় মাস (আগামী জুন পর্যন্ত) বাড়ানো হচ্ছে।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ওই প্রকল্পের আওতায় ২৯টি খাল ও ১টি জলাধারের পাড়ে মোট ১ হাজার ৯১০টি সীমানাখুঁটি বসানোর কথা। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮৫৮টি সীমানাখুঁটি বসানো হয়েছে। সীমানা চিহ্নিত না হওয়ায় খাল উদ্ধার করা যাচ্ছে না। এতে খাল পরিষ্কার করার কাজটিও ঠিকমতো হচ্ছে না বলে মনে করেন সিটি করপোরেশনের বর্জ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
ঢাকা উত্তর সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্র জানায়, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগ করে খাল পরিষ্কারের নিয়মিত কাজ চলে। তবে ওই কর্মীদের সিটি করপোরেশন সরাসরি নিয়োগ দেয় না। তাঁদের নিয়োগ হয় ঠিকাদারের মাধ্যমে। কিন্তু এসব কর্মী নিয়োগের জন্য ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ গত বছরের জুন মাসে শেষ হয়। এর পরে প্রায় সাত মাস নিয়মিত খাল পরিষ্কারের কাজ বন্ধ ছিল। গত জানুয়ারি মাসে নতুন চুক্তি হয়েছে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আগে নিয়ম ছিল একটি অঞ্চলের (উত্তর সিটিতে অঞ্চল রয়েছে ১০টি) অধীনে যে কয়েকটি ওয়ার্ড রয়েছে, সেসব ওয়ার্ডের ওপর দিয়ে যাওয়া খালের বর্জ্য পরিষ্কারের কাজ করবেন ঠিকাদারের নিয়োজিত সব কর্মী একসঙ্গে মিলে। এখন প্রতিটি ওয়ার্ডের কর্মীরা কাউন্সিলরদের অধীনে থেকে কাজ করছেন। এই কাজ আসলে বিচ্ছিন্নভাবে হচ্ছে। তদারকিও ঠিকমতো হচ্ছে না। ফলে কোনো খালই ঠিকভাবে পরিষ্কার হচ্ছে না। বিশেষ করে মিরপুরে থাকা অঞ্চল-২ ও ৪–এর খালগুলোতে এই সমস্যা বেশি হচ্ছে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের ওই কর্মকর্তা বলেন, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সংকট থাকায় খালের জন্য নিয়োজিত কর্মী দিয়ে ওয়ার্ডের রাস্তাঘাট ও নালা পরিষ্কারের কাজ করাচ্ছেন কাউন্সিলররা।
তিন বছর আগে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়ার পর খাল খনন ও সংস্কারে উত্তর সিটি করপোরেশন যতটা তৎপরতা দেখিয়েছে, পরে তা আর ধরে রাখতে পারেনি বলে মনে করছেন নগর–পরিকল্পনাবিদেরা। তাঁরা বলছেন, সিটি করপোরেশনের অগ্রাধিকারের তালিকায় খাল সংস্কার ও উন্নয়নের বিষয়টি থাকতে হবে।
এ বিষয়ে নগর–পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, খালে যাতে বর্জ্য ফেলা না হয়, সে জন্য খালপাড়ের বাসিন্দাদের সচেতন ও সম্পৃক্ত করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। খাল পরিষ্কারের জন্য সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম অনেকটাই অভিযানকেন্দ্রিক। কাজটি যে ধারাবাহিক তদারকির মাধ্যমে করে যেতে হয়, সেই পরিকল্পনা আসলে তাদের নেই।
মানুষের মনোভাব হয়ে গেছে সিটি করপোরেশন সবকিছু করে দেবে। এ কারণে খাল একবার পরিষ্কার করার পরে আবার আবর্জনায় ভরে যায়। সিটি করপোরেশনের পক্ষে এক-দুবার হয়তো পরিষ্কার করে দেওয়া সম্ভব, এর পরে কিন্তু এলাকাবাসীকেই খাল আবর্জনামুক্ত রাখার দায়িত্ব নিতে হবে। সবাই এগিয়ে না এলে কোনো কিছুই টেকসই হবে না।ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম