'৩২ নম্বরের' বাড়িটিই এখন ইতিহাস

দর্শনার্থীরা সিঁড়ির কাছে এসে কিছুক্ষণ থাকছেন, আবার চলে যাচ্ছেন। কিন্তু রাশিদা বেগম স্থির। তিনি বাড়িটির সিঁড়ির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। বেশ খানিকক্ষণ মুখে কোনো কথা নেই। তাঁর পরনে সাধারণ সুতি শাড়ি—ঘরে যেমন করে শাড়ি পরেন নারীরা, তেমনই। লক্ষ করি, শাড়ির আঁচল দিয়ে বার কয়েক চোখের পানি মুছলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব রাশিদা বেগম। তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই সিঁড়িতে, যেখানে ঘাতকের বুলেটে বিদ্ধ বঙ্গবন্ধুর প্রাণহীন দেহ পড়ে ছিল। এ সিঁড়ি ধানমন্ডির সেই বাড়ির, যার পরিচিত ‘৩২ নম্বর’ নামে। যেখানে প্রায় ১৪ বছর সপরিবারে ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের মহানায়ক।

আমাদের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রহরগুলো এখানেই গুনেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বাড়িটি দেখতে অনেক দিন ধরে অপেক্ষায় ছিলেন রাশিদা বেগমও। তাঁর বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুরে। এত কাছের শ্রীপুর, তারপরও আসা হয়ে ওঠেনি গ্রামীণ কৃষক পরিবারের এই নারীর। শ্রাবণ শুরুর এক সকালে ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে তাঁর সঙ্গে দেখা। দেখেই কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ছেলে মোহাম্মদ হালিম। তিনি অকপটে বললেন, ‘আমার আম্মা কিন্তু অ্যাক্কেবারে গ্রামের সাধারণ গৃহিণী। আপনাদের সঙ্গে ঠিকমতো হয়তো গুছিয়ে কথা বলতে পারবেন না।’

ছেলে জানালেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কখনো মেনে নিতে পারেন না তাঁর মা। আগস্টের সেই কালদিনটিতে তাঁর মা আকুল হন কান্নায়। হালিম বলছিলেন, ‘দুনিয়ার সবকিছু উল্টাইয়ে গেলেও শেখ মুজিব আর হাসিনা ছাড়া আম্মা কিছু বোঝেন না।’

বাড়িটি দেখার অপেক্ষায় ছিলেন রাশিদা। ঘুরে ঘুরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্নগুলো দেখার পর একরাশ বিষণ্নতা তাঁর চোখেমুখে। ধাতস্থ হওয়ার পর এটুকুই বললেন রাশিদা, ‘যেখানে শ্যাখ সাবের রক্ত আছে, সেইটাও দেখতে হইল।’

বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ বাড়িটি যেন সবাই দেখতে পারে, সে জন্যই বঙ্গবন্ধুর এই বাড়ি এখন জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছে বাড়িটি হস্তান্তর করা হয়। শেখ হাসিনা বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের জন্য বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করেন। ট্রাস্টই বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করে। নাম দেওয়া হয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর।’

আসলে বঙ্গবন্ধুর এই বাড়ির নম্বর ১০। বাড়িটি যে সড়কে, আগে এর নম্বর ছিল ৩২। সড়কের নামেই এখন বাড়িটির পরিচিতি। সড়কের এখন নতুন নম্বর ১১। তবে এই নম্বরটি বেশির ভাগ লোকই জানেন না। সবাই জানে ‘৩২ নম্বরই’।

ধানমন্ডির সেই ঐতিহাসিক বাড়িটি এখন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’

নতুন প্রজন্মের আরেফিনও এ নামেই চেনেন বাড়িটিকে। রংপুর ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর এখন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য ঢাকায় কোচিং করছেন। ১৭ মার্চ (বঙ্গবন্ধু জন্মদিন) ও ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর জীবনীর ওপর নানা ভিডিও দেখছেন তিনি। এরপর থেকেই ৩২ নম্বর বাড়িটি একবার নিজ চোখে দেখার ইচ্ছে। আরেফিনের কথা, ‘যিনি আমাদের জাতির পিতা, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, এ অন্যায়।’

বাড়িটির প্রতিটি জায়গায় ছড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধু, তাঁর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে এবং পরিবারের অন্যদের আরও অনেক স্মৃতি। ভবনটিতে ঢুকে নিচতলাতেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর বড় একটি প্রতিকৃতি। প্রথম ঘরে সাজিয়ে রাখা ছবিগুলো কথা বলছে ইতিহাসের নানা সময়ের। সেই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলাপচারিতা ও শুভেচ্ছাবিনিময়ের আলোকচিত্র আছে এখানে। এই কক্ষই ছিল ড্রয়িংরুম, যেখানে বসে বঙ্গবন্ধু দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই কক্ষের পাশের কক্ষটি ছিল বঙ্গবন্ধুর পড়ার ঘর। এখানে বসে তিনি লেখালেখিও করতেন। এখান থেকেই তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠিয়েছিলেন।

দোতলায় প্রথম ঘরটি বঙ্গবন্ধু ব্যবহার করতেন। এর পরের কক্ষটি ছিল তাঁর শোয়ার ঘর। পাশের কক্ষটি কন্যা শেখ রেহানার শোয়ার ঘর। কক্ষগুলোয় বিভিন্ন প্রদর্শনসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে শেখ রাসেলের খেলার জিনিস। আছে রাসেলের বল, হকিস্টিক, ব্যাট আর হেলমেট। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু ব্যবহৃত পাইপ, চশমাসহ বিভিন্ন জিনিস তো আছে। এসব ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্নের পাশাপাশি ঐতিহাসিক নানা ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষ্যও অমলিন এ বাড়িতে।

১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১–এর শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন—নানা চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী এই বাড়ি। এসব আন্দোলনের পরিকল্পনা প্রণয়ন, দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়, সাধারণ মানুষের দুঃখ–কষ্টের কথা শোনা—সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল ৩২ নম্বরের এই বাড়ি।

ইতিহাসের এসব ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী হতে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সারোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাড়িটি জাদুঘরে পরিণত করা একটা সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। প্রতিটি জিনিস দেখছি আর ভাবছি, এখানে বঙ্গবন্ধু ছিলেন, এখানে তাঁর স্পর্শ আছে। আমার কাছে কেমন জানি অবিশ্বাস্য মনে হয়। আমি বিমোহিত।’

প্রতিদিন এ জাদুঘরে গড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ দর্শনার্থী আসেন বলে জানান কিউরেটর নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দিবসে জনসামগম বেশি হয়। সব শ্রেণি-পেশার মানুষই আসেন। তবে নিম্নবিত্ত মানুষের আসার পরিমাণ বেশি।

দেশের মানুষই শুধু নন, এ জাদুঘরে ছুটে আসেন বাংলাদেশে আসা বিশ্বের নানা দেশের মানুষ। ওমানের নাগরিক হারিস ওসমানের সঙ্গে দেখা হলো এখানেই। সস্ত্রীক এসেছেন তিনি। বাংলাদেশে একটি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে ওসমান বলছিলেন, ‘আমি আপনাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের কিছুটা জানতাম দেশে থাকতেই। এ মাপের নেতা পাওয়াটা যেকোনো দেশের জন্য সৌভাগ্যের। সব দেশ এমন নেতা পায় না।’

বঙ্গবন্ধু পাখি ভালোবাসতেন। কবুতর মুক্ত আকাশে ছেড়ে দেওয়া হাসোজ্জ্বল বঙ্গবন্ধুর একাধিক ছবি সুপরিচিত। এ বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সময় থেকেই থাকা পায়রার খোপ এখনো আছে। পায়রা শান্তির প্রতীক। কিন্তু পায়রা থাকা, সবুজ গাছে ঘেরা বাড়িটি প্রত্যক্ষ করেছে এ দেশের সবচেয়ে কলঙ্কিত ঘটনার, যা ঘটেছিল ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে। বাড়িটি তাই নিছক বাড়ি নয়; এ দেশের আশা, আনন্দ আর দুঃখের এক স্বাক্ষর হয়ে আছে। নজরুল ইসলাম খান ২০১৬ সালের ১৭ মার্চ থেকে এখানে আছেন কিউরেটর হিসেবে। আশা-আনন্দ ও দুঃখের ব্যাখ্যা দেন নজরুল ইসলাম। বলেন, ‘আশা এই কারণে যে এই বাড়িকে কেন্দ্র করে, যিনি থাকতেন এই বাড়িতে সেই বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতি একটা আশার আলো দেখেছিল। এ বাড়ি থেকেই বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা তথা গৌরবের আসনের অধিষ্ঠিত করার প্রয়াস ছিল। তাই এখান থেকে আনন্দ উৎসারিত হয়েছিল।’

নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘একইভাবে এ বাড়ি থেকে বাঙালি জাতির কলঙ্কের অধ্যায় সূচিত হয়েছিল। এ বাড়িতে থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করেছিল পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে। তাঁকে হত্যারও সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানিরা তাঁকে হত্যা করতে পারেনি। তবে বাংলাদেশেরই কিছু বিপথগামী সৈনিক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। এর চেয়ে দুঃখের কাহিনি আর কী হতে পারে?’