তাসনিম মাহিরা তুবার বয়স মাত্র চার বছর। তাকে সবাই তুবা নামেই ডাকে। তুবা জানে তার মা তাসলিমা বেগম চিপস আনতে নিচে গিয়েছেন, একটু পরেই ফিরে আসবেন। তাই খেলার ফাঁকে বলতে থাকে, মাকে ফোন দাও। চিপস আনবে।
তবে গত শনিবার থেকে ছয় দিন ধরে মা আসছেন না। তাই ছোট তুবার মেজাজও ভালো যাচ্ছে না। সবকিছু নিয়ে বায়না করছে, বায়না মেটানো না হলেই চিৎকার, কান্নাকাটি করছে। বাসায় যে আসে সে–ই তুবার ছবি তুলতে চায়, এটাও তার পছন্দ না। তাই ঘরে অপরিচিত কেউ ঢুকে মুঠোফোন হাতে নিলেই বলে, ‘আমি ছবি তুলব না।’
ছেলেধরা সন্দেহে শনিবার রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে তুবার মা তাসলিমা বেগমকে হত্যা করা হয়। তাসলিমা বেগমের ১১ বছর বয়সী ছেলে তাহসিন আল মাহির বুঝে গেছে তার মা আর ফিরবেন না। বাবা-মায়ের তালাকের পর থেকে দুই বছর ধরে মাহির মা ও বোন থেকে আলাদা থেকেছে। প্রথমে বাবার সঙ্গে এবং পরে তাকে বাবা গ্রামের একটি স্কুলে ভর্তি করে দিলে মা ও বোনের সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়ে। তাই সেও তার বোনকে সেভাবে আগলে রাখতে পারছে না।
আজ বৃহস্পতিবার মহাখালীতে তাসলিমা বেগমের মায়ের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের সদস্যরা সবাই তুবার মেজাজ সামলাতে ব্যস্ত। ওকে কিছু বলাও যাচ্ছে না। তাই যখন যেটা বলছে, বায়না করছে তাই সামনে হাজির করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাসলিমা বেগমের মা, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা একমাত্র ভাই ও অন্য চার বোন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাসলিমা বেগমের দুই ছেলেমেয়েকে তাঁদের কাছে রাখবেন, পড়াশোনা করাবেন। ওদের বাবা সামান্য খরচ দিতেন, তাসলিমার মৃত্যুর পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে ছেলেমেয়েদের নিজের কাছে নিতেও চেয়েছেন। তবে আপাতত মামা, খালা ও নানির কাছেই থাকবে ওরা।
রোববার লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার সোনাপুর গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে তাসলিমাকে দাফন করা হয়েছে। মায়ের দাফন শেষে তাহসিন ও তাসনিম তুবা দুই ভাইবোন নানির বাসায় এসেছে। তুবা ও তার মা এই বাড়িতেই থাকতেন মায়ের সঙ্গে। তাই তুবার কাছে বাসার পরিবেশ অপরিচিত না লাগলেও চারপাশের মানুষের আচরণ পাল্টে গেছে, তা সে বুঝতে পারছে। তুবা রাতে তার খালা নাজমুন নাহারের সঙ্গে থাকছে।
তাসলিমার পরিবারের সদস্যরা এখন পর্যন্ত ঘটনাটি মেনে নিতে পারছেন না। নিরপরাধ একজন মানুষকে কেউ পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে তা তাঁদের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছে। মা সবুরা খাতুনের বাড়িতে থেকে বৃদ্ধ মায়ের দেখাশোনা করতেন তাসলিমা। মেয়ের এভাবে মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে তিনি শয্যাশায়ী। শুধু বললেন, তিনি মেয়ের হত্যার বিচার চান।
তাসলিমা বেগমের বড় বোন জয়নব বেগম বারবার বলছিলেন, এটা কেমন কথা? একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলল। মেয়েকে স্কুলে ভর্তির খোঁজখবর নিয়ে বের হলো, আর ঘরে ফিরল না।
তাসলিমা বেগম আগে চাকরি করতেন, তবে ছেলেমেয়ের দেখাশোনার জন্যই চাকরি ছেড়ে দেন।
তাসলিমা বেগমের মৃত্যুর পর তাঁর ভাগনে সৈয়দ নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় হত্যা মামলা করেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে এ ঘটনা তার প্রমাণ। খালার একটি আঙুল নড়ছে, মানুষ সেই আঙুলে পেটাচ্ছে, আবার পা নড়ছে, সেখানে মারছে। সাপ বা অন্য কোনো প্রাণীকেও কেউ এভাবে মারতে পারে না। মানুষ যখন বুঝতে পেরেছে খালার কোনো অঙ্গ আর কাজ করছে না তখন তারা মার থামিয়েছে।’
সৈয়দ নাসির উদ্দিন বলেন, যে স্কুলে তাসলিমা বেগম হত্যার শিকার হলেন, সেই স্কুল কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি। ঘটনার পর বাড্ডা থানায় স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেছিলেন, তিনি তাসলিমা বেগমকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু মানুষ ঢুকে গেলে তাঁকে আর আটকে রাখা সম্ভব হয়নি। নিচে নামিয়ে এনে পিটিয়ে মেরে ফেলে।
পুলিশের ভূমিকা প্রসঙ্গে সৈয়দ নাসির উদ্দিন বললেন, তাসলিমা বেগমের মৃত্যুর পর পুলিশ তৎপর হলেও তাঁকে বাঁচানোর জন্য পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে যায়নি। সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে বলে জানালেন সৈয়দ নাসির উদ্দিন। এ ছাড়া র্যাব থেকেও ফোন করেছে।
তাসলিমা বেগম হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামিসহ এখন পর্যন্ত মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বুধবার গ্রেপ্তারের এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. মাসুদুর রহমান।
আজ দুপুরে উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার হাফ স্কুল থাকায় তা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে আশপাশের জনগণের মধ্যে স্কুলটি ঘিরে কৌতূহল শেষ হয়নি। যাঁরা ঘটনার সময় এলাকায় ছিলেন না তাঁরা স্কুলটি দেখতে এসেছেন, উঁকি দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করছেন। স্কুলের আশপাশের বিভিন্ন দোকান, মাদ্রাসা, মসজিদের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তাঁরাও ঘটনার আকস্মিকতায় মুষড়ে পড়েছেন। তবে সবার এক কথা, ছেলেধরা গুজব বন্ধ করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
স্কুলের আয়া জান্নাত বললেন, ‘ওই নারী আমার কাছে এসে বাচ্চার ভর্তির কথা জানতে চান। আমি বলি, এখন ভর্তি করা যাইব না। তারপর দেখি ওই নারীকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আপার রুমে নিয়া গেল কয়েকজন। এর মধ্যেই দেখি স্কুলের মাঠে সমানে মানুষ জড়ো হইতাছে। ওয়াল টপকাইয়্যা একেকজন ঢুকতাছে। তারপর স্কুলের কলাপসিবল গেটে তালা লাগাইয়্যা দিলাম। কিন্তু মানুষ তালা ভাইঙ্গা ওপরে গেল, ওই নারীরে নিচে নামাইয়্যা আনল, তারপর তো শুনি সব শেষ।’