ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে কথা বলতে চাই—প্রশ্নটা শুনেই একটু থমকে গেলেন উম্মে হাবিবা (সুমি)। আজিমপুর এস্টেট কলোনির বাসিন্দা হাবিবার চোখমুখে ফুটে উঠল অসহায়ত্ব। এই পরিবারের পাঁচজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। তিনি বললেন, কর্তৃপক্ষের অবহেলায় একটা পরিবার কতটা ভুগতে পারে, তা বলে বোঝানো সম্ভব না। অপরাধ না করেও এ কেমন শাস্তি?
হাবিবার দেড় বছরের ছেলে জোহা ২৬ জুন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এরপর জুলাই মাসে তাঁর স্বামী ইকবাল হোসেন, দেড় বছর বয়সী মেয়ে জোয়া, ২০ বছর বয়সী মানসিক প্রতিবন্ধী বোন সায়মা এবং দুই বছর বয়সী ভাগনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়।
শুধু হাবিবার পরিবার নয়, আজিমপুর এস্টেট কলোনির অনেক পরিবারেই এমন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী আছেন। গত বৃহস্পতিবার আজিমপুর এলাকার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের খোঁজ নিতে যান এই প্রতিবেদক। আজিমপুর এস্টেটের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কলোনির ৩১টি ভবনের অধিকাংশ ভবনেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী আছেন।
কমপক্ষে একজন সদস্য ডেঙ্গুতে আক্রান্ত আছেন বা ছিলেন এমন সাতটি পরিবারের সঙ্গে কথা হয়। এসব পরিবারের সদস্যরা বলেন, গত জুনের শেষ সপ্তাহে কলোনিতে ডেঙ্গু জ্বর দেখা দেয়। কলোনিতে ৪১৮টি ফ্ল্যাট আছে। গত জুলাই মাসে কলোনির ৭০-৮০ জনের ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। একই পরিবারের একাধিক সদস্যেরও ডেঙ্গু হয়েছে।
২৫ নম্বর ভবনের বাসিন্দা আবদুল গফুর অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। গত ২৫ জুলাই জ্বর ও রক্ত বমি নিয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। গফুর প্রথম আলোকে বলেন, আশপাশের প্রতিটি ভবনেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী আছে। প্রতিদিন কেউ না কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে।
কলোনির একজন নিরাপত্তারক্ষী বললেন, গত সপ্তাহে এলাকার লোকজনকে নিয়ে মেয়র সাঈদ খোকন সভা করেছেন। মেয়র বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার করতে বলেছেন। কিন্তু অনেক বাড়ির পেছনে এখনো নোংরা। তিনি জানালেন, কলোনির ২৪ নম্বর ভবনের নিচতলার বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন ডেঙ্গু আক্রান্ত।
দেলোয়ার হোসেন একটি বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করেন। তাঁর স্ত্রী সরকারি কর্মকর্তা নাজমুন নাহার বললেন, গত ২৪ জুলাই তাঁর স্বামীর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। প্লাটিলেট ২০ হাজারে নেমে গিয়েছিল। সাত দিন হাসপাতালে থেকে বাসায় ফিরেছেন
একসময় অসুস্থ দেলোয়ার হোসেন নিজেই ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। অনেকটা উত্তেজিত দেলোয়ার বলতে থাকেন, ‘সাঈদ খোকন আসুক, কত ডেঙ্গু রোগী লাগবে এই কলোনির বাসিন্দাদের মধ্যে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা মশারি টানিয়েও রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় কাউন্সিলরকে বারবার বলেও এলাকায় মশার ওষুধ দেওয়ানো যায় না।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গণপূর্ত কলোনির নালাগুলো পরিষ্কার করে না। অপরিষ্কার নালার মধ্যেই মশার লার্ভা মারার ওষুধ ছিটানো হয়। কলোনির বাসিন্দাদের একাধিকবার তাঁদের আঙিনা পরিষ্কার করতে বলা হয়েছে।
চার দিন পরপর সিটি করপোরেশনের কর্মীরা কলোনিতে মশার ওষুধ দিতে আসেন বলে জানালেন আজিমপুর এস্টেট জনকল্যাণ সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ কে এম ফজলুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কলোনির নালাগুলোর অবস্থা করুণ। গণপূর্ত নিয়মিত পরিষ্কার করে না। অনেকবার বলার পরে সাত-আট দিন ধরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা আসছেন।
দেখা যায়, কলোনির প্রতিটি ভবনের সামনে ও পেছনে পানি নিষ্কাশনের উন্মুক্ত নালা। সেখানে পানি জমে আছে। কিছু নালায় ময়লা-আবর্জনা জমে আছে। কোথাও গণপূর্ত বিভাগের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নালার ময়লা তুলে পাশেই রেখে দিয়েছেন।
২৪ নম্বর ভবনের বাসিন্দা রাবেয়া আকতার ও তাঁর বোন সাহেরা ইসলাম ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বাসায় আছেন। রাবেয়া আকতার বলেন, ‘বাসার সামনেই খোলা ড্রেন। তাতে মশার উৎপাদন। এভাবে থাকা যায় বলেন?’
নালাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় বলে দাবি করলেন গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী ইলিয়াস আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কলোনির ভবনগুলো মেরামত ও ব্যবহারের উপযোগী রাখা গণপূর্তের কাজ। নালাগুলোও পরিষ্কার করা হয়। ভবনের বাসিন্দারা নানা ধরনের বর্জ্য নালায়, ভবনের আশপাশে ফেলেন। বাসিন্দাদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
দেখা যায়, ভবনগুলোর পেছনের অংশে বারোয়ারি বর্জ্য পড়ে আছে। একাধিক ভবনের পেছনে প্লাস্টিকের খালি বোতল, চিপসের প্যাকেট, নারিকেলের খোসা জমে আছে। যেগুলোয় জমে থাকা পানিতে অনায়াসে ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশার জন্ম হতে পারে।
গণপূর্ত ও সিটি করপোরেশন কেউই তাঁদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেননি বলে জানান কলোনির বাসিন্দা ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘গণপূর্ত নালা পরিষ্কার করেনি। নিজেদের টাকায় নালা পরিষ্কার করাতে হয়েছে। সিটি করপোরেশন মশার লার্ভা মারার ওষুধ দেয়নি। এখন ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী। এরপরেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না।’