পুরোনো ঢাকার বাংলাবাজার–প্যারীদাস রোড থেকে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বইয়ের দোকান। কয়েক বছর আগে যেখানে ছিল দুই বাংলা থেকে প্রকাশিত বইয়ের পাইকারি দোকান, আজ সেখানে দেখি মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশের দোকান। এলাকাটি আগে বইপাড়া হিসেবেই পরিচিত ছিল। অনেক প্রকাশক এখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন, অনেকে কোনো রকমে ছোট্ট পরিসরে টিকে আছেন।
টিকে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’। দেশের প্রকাশনা জগতে এক ঐতিহ্যবাহী নাম। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের দেওয়া সেই নামটি জ্বলজ্বল করলেও, এখনকার দোকানে আগের সেই জৌলুশ নেই। একসময় এই প্রকাশনী থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, ‘দুই তীর’, আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’, সত্যজিৎ রায়ের রচনাবলিসহ আরও নানা ধরনের বই।
১৯৪৪ সালে প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক মোহাম্মদ নাসির আলী এবং তাঁর বন্ধু আইনুল হক খান কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘নবযুগ লাইব্রেরী’। পরে কবি নজরুলের দেওয়া নাম নিয়ে ‘নবযুগ লাইব্রেরী’ হয় ‘নওরোজ লাইব্রেরী’। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে ঢাকার বাংলাবাজারে নতুন করে যাত্রা শুরু করে ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’। বাংলাবাজারের পি কে রায় রোডে বেশ বড় একটি বইয়ের দোকান ছিল।
আজ বুধবার বাংলাবাজারে কথা হলো নওরোজ কিতাবিস্তানের বর্তমান প্রকাশক মনজুর খান চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, ১৯৭৫ সালে মোহাম্মদ নাসির আলী মৃত্যুবরণ করেন। তারপর নওরোজ কিতাবিস্তান ভাগ হয়ে যায়। আলী পরিবার পায় নওরোজ কিতাবিস্তানের অবকাঠামো আর খান পরিবার পায় ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’ নামটি। অন্য অংশের নাম হয় নওরোজ সাহিত্য সম্ভার। প্রতিষ্ঠানের সহপ্রতিষ্ঠাতা আইনুল হক খানের ছেলে আবদুল কাদির খান রাজধানীর নিউমার্কেটে নওরোজ কিতাবিস্তানের নতুন দোকান খোলেন। আশির দশকের শেষের দিকে নওরোজ কিতাবিস্তান আবার বাংলাবাজারে ফিরে আসে।
মনজুর বললেন, ‘২০০০ সালে খালু (আবদুল কাদির খান) মারা গেলে প্রতিষ্ঠানটি অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে। কাদির সাহেবের ছেলেও ছিলেন আমেরিকায়। তখন এটি চালানোর ভার পড়ে আমার ওপর।’ নওরোজ কিতাবিস্তানের অধীনে এখন প্রায় ৩ হাজার বই বাজারে আছে। তিনি বললেন, ‘বাংলাসাহিত্যের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ঐতিহ্য ধরে রেখে আমরা সৃজনশীল বই প্রকাশ করে যেতে চাই।’
নওরোজ কিতাবিস্তানের জমজমাট অবস্থা এখন আর নেই। ৫ নম্বর বাংলাবাজারে ছোট্ট ও সরু একটি দোকান। চারজন কর্মী নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে নিচ্ছেন মনজুর। তিনি জানালেন, আগে পাঠক ও বই ব্যবসায়ীরা নিজেরাই এখানে চলে আসতেন। আর এখন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের পাঠক ও বই ব্যবসায়ীদের কাছে ছুটে যেতে হয়। মনজুর আরও বললেন, ‘আরও বড় পরিসরে কিছু করতে চাই। আমরা হয়তো টাইটানিক নই। কিন্তু কলাগাছের ভেলার মতো হলেও আমরা টিকে থাকতে চাই।’