রাজধানীর কল্যাণপুরে অভিভাবকহীন প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী শিশুসহ ৭২ জনকে প্রতিদিন খাবার দেওয়াই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। এই প্রবীণ ও শিশুরা ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’–এ আশ্রয় পেয়েছেন। কল্যাণপুরের পাইকপাড়ায় (বাড়ি: ৪৬২, সড়ক: ০৮ দক্ষিণ পাইপাড়া) অল্প দূরত্বে দুটি বাড়িতে ১৬টি ঘরে থাকছে প্রবীণ ও শিশুরা। বর্তমানে আছে ৬৬ জন প্রবীণ ও ৬টি শিশু।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নেওয়া অলাভজনক এবং একক ব্যক্তি উদ্যোগে গঠিত এ কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী ও তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মিল্টন সমাদ্দার। প্রতিষ্ঠানটি তত্ত্বাবধানে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন তাঁর স্ত্রী মিঠু হালদার। এখানে থাকা প্রবীণেরা এই দম্পতির ছেলে সূর্যকে নাতি এবং মিল্টন সমাদ্দারকে ছেলে ও স্ত্রীকে ছেলের বউ হিসেবেই সম্বোধন করেন। এই দম্পতির নিজস্ব আয় এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তি উদ্যোগ ও সহায়তায় মিল্টন সমাদ্দার কেন্দ্রটি পরিচালনা করেন। এখানে প্রবীণদের চিকিৎসার জন্য আছে প্রয়োজনীয় ওষুধের ছোট ডিসপেনসারি, যন্ত্রপাতি আর অক্সিজেন সিলিন্ডার। একজন চিকিৎসক বৃহস্পতিবার এসে দেখে যান সবাইকে। রান্না ও পরিচর্যার জন্য সার্বক্ষণিক কর্মী আছেন ১৯ জন।
করোনাভাইরাসের বিস্তারে সহায়তা পাওয়ার পরিমাণ কমে গেছে। এই সময়ে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষে সেখানে গিয়েও সহায়তা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এই বিশাল পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া কত দিন সম্ভব হবে, তা নিয়েই আতঙ্কিত মিল্টন সমাদ্দার।
এখানে আশ্রয় পাওয়া প্রবীণদের সংসারে ঠাঁই হয়নি। পথের ধারে পড়ে থাকা প্রবীণকে তুলে এনেছেন মিল্টন সমাদ্দার বা কাউকে ছেলেমেয়েরাই এখানে দিয়ে গিয়েছেন। কেউ কেউ নিজেই যোগাযোগ করে চলে এসেছেন। প্রবীণদের কারও মৃত্যু হলে তাঁর ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সৎকারের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে মিলটন সমাদ্দারকেই।মিল্টন সমাদ্দার জানান, তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসা এবং তাঁর পরিচালিত একটি নার্সিং এজেন্সি করোনাভাইরাসের বিস্তারের ফলে বন্ধ আছে। ফেসবুকের শুভাকাঙ্ক্ষীসহ অন্যদের কাছ থেকে দান–সহযোগিতার পরিমাণ কমে গেছে। অথচ বাড়িভাড়া, সবার খাবার, চিকিৎসাসহ মাসেই খরচ হয় প্রায় ১১ লাখ টাকা। এই সময়ে তাঁদের পাশে মানুষ না দাঁড়ালে ডাল–ভাত খাবারের সংস্থান করাই কষ্টকর হয়ে যাবে।
এই সময়ে যাঁরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন মিল্টন সমাদ্দার। মিল্টন সমাদ্দার বললেন, ‘করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধে প্রবীণ ও শিশুদের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার পেছনেই অনেক খরচ করতে হচ্ছে। খাবার তো আছেই। তবে এখন পর্যন্ত কারও শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রবীণদের অনেকের শরীরেই ঘা, পচন তো আগে থেকেই আছে।’
তবে করোনাকালেও প্রবীণের আসা বন্ধ হয়নি কেন্দ্রটিতে। করোনাকালেই মিরপুরের একটি সড়কে পড়ে থাকা ৮৫ বছর বয়সের জাহানারা বেগম কেন্দ্রটিতে এসেছেন। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ও অসুস্থ।
মিল্টন সমাদ্দার বললেন, একজনের সহায়তায় এই প্রবীণকে এখানে আনা হয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরপুরেই এই নারীর ছয়তলা বাড়ি আছে। স্বামী প্রবাসী। সন্তানদের সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে তিনি আত্মীয়দের সঙ্গে থাকতেন, একা বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আত্মীয়রা নিয়ে যাবেন বলে বলেছেন। মিল্টন সমাদ্দার বললেন, এখানে যাঁরা আছেন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই এ ধরনের একটি করে জীবনের গল্প আছে। থানায় প্রত্যেকের নামে সব তথ্য দিয়ে সাধারণ ডায়েরি করা আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছবি বা জীবনের গল্পগুলো দিলে কারও কারও সন্তান বা আত্মীয়রা এসে নিজেদের কাছে নিয়েও যান, তবে সে সংখ্যাটা খুবই কম।
কেন্দ্রটিতে প্রবীণেরা পত্রিকা পড়ে, টেলিভিশন দেখে বা নিজেদের মধ্যে গল্প করে সময় কাটান। অনেক সময় মিল্টন ও মিঠু দম্পতির ছেলে সূর্যকে নিয়ে খেলতে বসে যান। এখানে আশ্রয় পেয়েছে ময়না, টিয়া, রাতুল, সোয়াত, তৈয়বা ও সৃষ্টি। একদম ছোটজনের বয়স মাত্র তিন বছর। সবাই প্রতিবন্ধী নয়, তবে সবাই অভিভাবকহীন। কেউ এসেছে থানার মাধ্যমে আবার কেউ এসেছে মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তায়। কাউকে কাউকে রাস্তা থেকে তুলে আনা হয়েছে।
বরিশালের মিলটন সমাদ্দার নার্সিং পাস করলেও চাকরি করা হয়নি। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে অসুস্থ প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য তাঁর একটি দল কাজ করতে গিয়েই একজন প্রবীণ সদস্যকে নিয়ে অসহায় প্রবীণদের আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করেছিলেন। কেন্দ্রটির যাত্রা শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে। ওই বছর ডিসেম্বর মাসে তিনি একজন পায়ে গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত বৃদ্ধকে আগারগাঁওয়ের সড়ক থেকে তুলে এনেছিলেন নিজের বাসায়। চিকিৎসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ১৪ দিনের মাথায় তিনি মারা যান। মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রীও রাজধানীর একটি হাসপাতালের নার্স।