রাজধানীর শাহবাগ থেকে গতকাল মধ্যরাতে শেকল ভাঙার পদযাত্রায় অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, নারী অধিকারকর্মী, পেশাজীবী ও শিল্পীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারী-পুরুষেরা
রাজধানীর শাহবাগ থেকে গতকাল মধ্যরাতে শেকল ভাঙার পদযাত্রায় অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, নারী অধিকারকর্মী, পেশাজীবী ও শিল্পীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারী-পুরুষেরা

‘৭২ ঘণ্টা পার হলে ধর্ষণ ন্যায্য?’

‘৭২ ঘণ্টা পার হলে ধর্ষণ ন্যায্য?,’ ‘চরিত্রের প্রশ্নে বিচারহীন, আর কত দিন’, ‘চলন-বলন-পোশাক রাখো, রাষ্ট্র এবার দায় নাও’, ‘পুরুষের ক্ষমতা, ভেঙে হোক সমতা’, ‘পথে-ঘাটে দিনে-রাতে, চলতে চাই নিরাপদে’ এ রকম নানান প্ল্যাকার্ড আর স্লোগানে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে মুখরিত ছিল রাজধানীর শাহবাগ।

গতকাল মধ্যরাতে ঢাকার শাহবাগ থেকে ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা’ শুরু হয়৷ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের মামলায় পাঁচ আসামিকে খালাস দেওয়া এবং ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণ মামলা না নেওয়ার বিষয়ে আদালতের এক নির্দেশনার প্রতিবাদে এই কর্মসূচি চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, নারী অধিকারকর্মী, পেশাজীবী ও শিল্পীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারী-পুরুষেরা পদযাত্রায় অংশ নেন। দাবি তোলেন, ১৮৭২ সালে প্রণীত সাক্ষ্যপ্রমাণ আইনের ১৫৫(৪) ধারা বাতিলের।

২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাতে রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। এ মামলায় ওই বছরের ৮ জুন সাফাতসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এর পরের মাসেই (২০১৭ সালের ১৩ জুলাই) পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ৪৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনকে আদালতে হাজির করা হয়।

মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, জন্মদিনের পার্টির কথা বলে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই তরুণীকে ধর্ষণ করেন সাফাত ও তাঁর বন্ধু নাঈম।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ঘটনার ৩৮ দিন পর ধর্ষণের অভিযোগ মেডিকেল প্রতিবেদনকে সমর্থন করে না। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ অহেতুক আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছে। এই মামলায় বিচারকাজে ৯৩ কার্যদিবসে প্রচুর কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। এ সময়ে বিচারাধীন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হতো বলে মনে করেন আদালত।

আদালতের এমন রায়ের প্রতিবাদে শাহবাগ থেকে বের হওয়া শেকল ভাঙার পদযাত্রা কর্মসূচিতে মশালমিছিল করে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে যান এতে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা৷ সংসদ ভবনের সামনে তাঁরা একটি প্রতিবাদ সমাবেশ করেন৷ সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা বাতিলের দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচিও করা হয়৷

এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ বলেন, ‘একবিংশ শতকে এসে একটি স্বাধীন দেশে এ ধরনের রায় হতে পারে না৷ আদালতের বিচার করার কথা, ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট (চারিত্রিক সনদ) দেওয়ার কথা নয়৷ বিচারক পুলিশকে বলছেন, ৭২ ঘণ্টার পরে ধর্ষণ মামলা না নিতে৷ তার মানে, ধর্ষণ করে ৭২ ঘণ্টা নারীকে আটকে রাখলেই পুলিশ আর মামলা নেবে না?’

আইনজীবী ফারাহ হোসেন বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছি৷ আজ একটি মামলার রায়ে দেখা গেল, যে নারীরা বিচার চাইতে এসেছেন, তাঁদের বিচার না দিয়ে বরং তাঁদের চরিত্র নিয়ে কথা বলা হলো৷ বলা হলো যে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে না হলে তাঁর মামলা নেওয়া হবে না৷ এটি অত্যন্ত নিন্দনীয়।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী প্রাপ্তি তাপসী বলেন, ‘রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থীর ধর্ষণ মামলার রায়ে এক বিচারক আদালতে বলেছেন যে ধর্ষণের ঘটনার তিন দিন পরে মামলা করতে কেউ থানায় গেলে সেই মামলা যেন না নেওয়া হয়৷ বিচারব্যবস্থা কেমন হলে একজন বিচারক আদালতে দাঁড়িয়ে এমন কথা বলতে পারেন! সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারার মাধ্যমে রাষ্ট্র ভুক্তভোগীর চরিত্র বিচার করার মাপকাঠি ঠিক করে দেয়৷ আমরা বিশ্বাস করি, রাষ্ট্র কখনো নারীর চরিত্র নিরূপণের মাপকাঠি ঠিক করে দিতে পারে না। আমরা সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা বাতিল চাই৷’

এই পদযাত্রায় অন্যদের মধ্যে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, সংগীতশিল্পী কৃষ্ণকলি, অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনাসহ অনেকে অংশ নেন৷