মিরপুরে এক খণ্ড জমির জন্য চাকরিজীবনের সঞ্চয়ের একটি বড় অংশ জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছিলেন প্রকৌশলী আবদুল আজিজ। ১৯৯৪ সালে তাঁকে প্লটের বরাদ্দপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু জমি বুঝে পাননি।
২০০৪ সালে মারা যান আবদুল আজিজ। এরপর পেরিয়েছে আরও ১৭ বছর। কিন্তু এখনো তাঁর পরিবারকে প্লট বুঝিয়ে দিতে পারেনি জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। কবে পারবে, তা–ও বলতে পারছেন না সংস্থাটির কেউ।
আবদুল আজিজের বড় ছেলে জাকারিয়া আরেফিন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, প্লটের দখল বুঝে পেতে তাঁর বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ফল পাননি। তাঁরাও এখন দিন গুনছেন।
ঢাকার মিরপুরের ১১ নম্বর সেকশনের বি ব্লকে আবদুল আজিজের মতো ১৪৪ জন গ্রাহককে প্লটের বরাদ্দপত্র দিয়েছিল গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। দুই কাঠার একেকটি প্লটের জন্য তিন কিস্তিতে এক লাখ ২৮ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছিল। ঢাকায় নিজের এক টুকরা জমির আশায় থাকতে থাকতে ইতিমধ্যে ১৯ জন গ্রাহক মারা গেছেন। বাকিদের বেশির ভাগও জীবনসায়াহ্নে।
দুই আয়তনের একেকটি প্লটের জন্য নেওয়া হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। ১৯৮৬ সালে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। ২৭ বছর আগে রোড ও প্লট নম্বর উল্লেখ করে বরাদ্দপত্র দেওয়া হয়।
মিরপুরের যে জায়গায় প্লট দেওয়া হয়েছিল, সেখানে এখন আটকে পড়া পাকিস্তানিরা (বিহারি) বসবাস করেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, জমি খালি করার বিষয়টি নিয়ে একটি রিট এখনো বিচারাধীন। আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সেখান থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও নেওয়ার বিষয়টিতে সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।
জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সদস্য (ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা) মইনুল হক আনছারী প্রথম আলোকে বলেন, ইচ্ছা থাকার পরও সব সময় সবকিছু করা যায় না। তবে মূল মালিকদের প্লট বুঝিয়ে দিতে তাঁদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। তাঁর দাবি, মিরপুর ৮ নম্বর সেকশনে ১৯৯৪ সালে বরাদ্দ দেওয়া জমি ২০১৯ সালে দখলদারের হাত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাই তাদের ক্ষেত্রে ইতিবাচক উদাহরণও রয়েছে।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, মিরপুরে ১৪৪ জনকে যে প্লট দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর জন্য ১৯৮৬ সালে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। তখন এই সংস্থাটির নাম ছিল গৃহ-সংস্থান অধিদপ্তর।
জানা যায়, ১৯৯১ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় প্লটের জমিতে মাটি ভরাট করে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। ১৯৯৪ সালে রোড ও প্লট নম্বর উল্লেখ করে বরাদ্দপত্র দেওয়া হয়। এর দুই বছর পর প্লটের দখল বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। অবশ্য তা দেওয়া হয়নি। এই ফাঁকে জমি বেদখল হতে শুরু করে। একপর্যায়ে আটকে পড়া পাকিস্তানি ও বাঙালীদের অনেকে সেখানে বসবাস শুরু করেন।
প্লট বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তি, আটকে পড়া পাকিস্তানি ও গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০২ সালে হাইকোর্টে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিহারিরা সেখানে থাকার সুযোগ পান। এরপর দুই দফা বিহারিদের রিট খারিজ হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে আটকে পড়া পাকিস্তানিরা ক্যাম্পের সীমানা চিহ্নিতকরণের আরজি করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল ১৯০৭/২০১৯ দায়ের করেন। সেটি এখন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
ইচ্ছা থাকার পরও সব সময় সবকিছু করা যায় না। তবে মূল মালিকদের প্লট বুঝিয়ে দিতে তাঁদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। মিরপুর ৮ নম্বর সেকশনে ১৯৯৪ সালে বরাদ্দ দেওয়া জমি ২০১৯ সালে দখলদারের হাত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাই তাদের ক্ষেত্রে ইতিবাচক উদাহরণও রয়েছে।মইনুল হক আনছারী, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সদস্য (ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা)
বিহারিদের পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করা সংগঠন উর্দু স্পিকিং পিপলস ইয়ুথ রিহেবিলিটেশন মুভমেন্টের সভাপতি সাদাকাত খান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে সেই জমিতে প্রায় ১ হাজার ২০০ পরিবার বাস করে। আগে তাঁরা একই এলাকায় কালশী রোডের পাশে সাংবাদিক কলোনির প্লটে ছিলেন। সেখান থেকে তাঁদের সরিয়ে গৃহায়ণের জমিতে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। এটা আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা হলে তাঁরা সেখান থেকে সরে যাবেন।
বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিরা বলছেন, বিহারিদের পক্ষে করা রিট দুই দফা খারিজ হওয়া সত্ত্বেও ঠিক সময়ে উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই এখন পর্যন্ত তাঁরা দখল বুঝে পাচ্ছেন না। তবে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০১৬ সালে তারা উচ্ছেদের পদক্ষেপ নিয়ে সেখানে গিয়েছিল। কিন্তু ওই দিনই আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসার কারণে অভিযান চালাতে পারেনি। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে অবস্থানরতদের উচ্ছেদ এখন কঠিন হয়ে গেছে।
ঢাকার মিরপুরের ১১ নম্বর সেকশনের বি ব্লকে আবদুল আজিজের মতো ১৪৪ জন গ্রাহককে প্লটের বরাদ্দপত্র দিয়েছিল গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। দুই কাঠার একেকটি প্লটের জন্য তিন কিস্তিতে এক লাখ ২৮ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছিল। ঢাকায় নিজের এক টুকরা জমির আশায় থাকতে থাকতে ইতিমধ্যে ১৯ জন গ্রাহক মারা গেছেন। বাকিদের বেশির ভাগও জীবনসায়াহ্নে।
গৃহায়ণের কর্মকর্তারা মনে করেন, স্থানীয় সরকার বিভাগ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সাংসদসহ সংশ্লিষ্টরা সমন্বিত পদক্ষেপ নিলে উচ্ছেদ অভিযান চালানো সম্ভব হবে। এই কাজে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকেও যুক্ত করতে হবে। তারা সড়ক দখলমুক্ত করলে জমির একাংশ খালি হবে।
ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আইনি কোনো জটিলতা না থাকলে এবং গৃহায়ণ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হলে উচ্ছেদ কার্যক্রমে তাঁরা অংশ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবেন।
এই প্রকল্পের দেখভাল করছে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মিরপুরে অবস্থিত ঢাকা বিভাগ-১। এই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জোয়ারদার তাবেদুন নবী প্রথম আলোকে বলেন, উচ্ছেদ অভিযানের জন্য তাঁরা প্রস্তুত। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা ও অনুমতি পেলে তাঁরা অভিযান চালাবেন।
অবশ্য প্লট বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের অভিযোগ, সবাই শুধু মৌখিক আশ্বাস দেয়। কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। কিন্তু আটকে পড়া পাকিস্তানিদের করা রিট মামলা লড়তে প্লট বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের অর্থ খরচ হচ্ছে। যদিও এই মামলার বিবাদী গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। প্লট মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা দাবি করেন, এখন পর্যন্ত তাঁরা ২২ লাখ টাকা খরচ করেছেন।