১১২ দিন ধরে আমি বাসার ভেতর। আল্লাহর রহমতে আমার এতে তেমন কিছু অসুবিধা হয়নি, হচ্ছে না। বাসায় কোনো রকম কাজের লোক না থাকায় বরং নিজের কাজের সঙ্গে বুয়াদের কাজ মিলিয়ে বেশ ব্যস্ত থাকি। ব্যস্ত থাকি লেখালেখি নিয়ে। এই লেখালেখি যদি না থাকত, হয়তো বেঁচে থাকাটা আরও কঠিন হতো আমার। কিংবা হয়তো সেভাবেই মানিয়ে নিতাম আমার জীবন।
আমি খুব ছোটবেলায় ডাইনোসরদের বিলুপ্তির ইতিহাস পড়েছিলাম। আর তখন থেকে একটা লাইন আমার মনে–মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। তা হলো, প্রকৃতির পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি বলেই ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছে। আর এটাও জেনেছি মানুষ এখন পর্যন্ত টিকে আছে প্রকৃতির পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার কারণে।
আমিও সেই মানুষ, আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের দৃঢ়তা, নিজের ওপর আস্থা ও মনোবলকে সম্বল করে আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো থাকার চেষ্টা করছি, ভালো আছি।
চারদিকে লকডাউন। একের পর এক মৃত্যুসংবাদ। আমার সমবয়সী খুব কাছের একজন স্বামীর বন্ধুর স্ত্রী, তিনি করোনায় মারা গেলেন। তাঁরা স্বামী–স্ত্রী ১০ দিন জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পরও দুজনই বুঝতে পারেননি তাঁদের করোনা হয়েছিল। দুজনই মোটামুটি সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ ভাবির শ্বাসকষ্ট শুরু হলে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরিবারের আর কেউ তাঁকে দেখতে পারেনি। তিনিও কাউকেই আর দেখার সুযোগ পাননি। তিন দিন পরে জানানো হলো ভাবি মারা গেছেন। আজিমপুরে দাফন হলো। পরিবার থেকে দুজন থাকতে পারলেন জানাজায়।
বুকের ভেতর এই মৃত্যুসংবাদটা খুব পোড়াল আমায়। কত স্মৃতি এই মানুষটার সঙ্গে। কী ভিষণ ভালোবাসতেন আমায়। আল্লাহ ভাবিকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন।
এর কিছুদিন পরে মারা গেলেন আমাদের পারিবারিক বন্ধুর ভাইটা। ২৫ দিন তাদের পরিবারের চারজনের করোনা পজেটিভ নিয়ে হাসপাতালে ছিলেন। বর্তমানে যে হাসপাতাল করোনা রিপোর্ট নিয়ে বিতর্কিত। সুস্থ হতে হতে ওই ভাইয়া শ্বাসকষ্টে মারা গেলেন। আমরা পারিবারিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত। তবু জীবন চলছিল জীবনের নিয়মে।
মারা গেলেন ছেলের বন্ধুর ভাই, আশপাশের বিল্ডিংয়ের দু–চারজন। আত্মীয়স্বজন বন্ধুদের অসুস্থতার খবর আসছে। অ্যাম্বুলেন্সের নিয়মিত সাইরেন। আমি তো পত্রিকা পড়া ও টিভি নিউজ দেখা ছেড়েই দিলাম। নিতে পারছিলাম না এই করোনার ভয়াবহতা।
এক এক করে বিচলিত হয়ে বাধ্য হচ্ছিলাম নিজে। এমন সময় শুরু হলো প্রকৃতির আরেক বিপর্যয় আমফান ঝড়। এর এক সকালে ফজরের নামাজের পর জানালার কাছে বসে আমফান ঝড়ের তাণ্ডব দেখছিলাম বাইরে। সব মিলিয়ে আমার খুব অসহায়ত্বের কান্না পাচ্ছিল। খুব কাঁদলাম আর স্রষ্টাকে বললাম। আমার আর কোনো প্রিয়জনকে নিয়ো না। আমি তোমার কাছে নতজানু হলাম। সমর্পিত হলাম। আমায় কবুল করুন। ক্ষমা করুন আল্লাহ। বিনিময়ে আমার সব প্রিয়জনকে আর পৃথিবীর মানুষকে মুক্তি দিন। ওই দিনই স্রষ্টার কাছে সমর্পণের আকুতি নিয়ে একটা কবিতাও লিখলাম।
মনে মনে নিজেকে তৈরি করতে থাকলাম পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার জন্য। যদি আল্লাহ আমাকে কবুল করেন আর মুক্তি দেন পৃথিবীর মানুষকে এই মহামারি থেকেই। এই চাওয়ার জন্য ক্ষমাও চাইলাম যদি ভুল হয় চাওয়া।
এর মধ্যেই আমার খুবই নিকট আত্মীয়ের বাসায় তিনজনের করোনা পজিটিভ হলো। খুব ভয় পেলাম। আল্লাহর রহমতে তারা সবাই সুস্থ হয়ে উঠল। মনে শক্তি বাড়ল।
এর মধ্যেই ৮০ বছরের বেশি বয়সের আমার চাচাশ্বশুর করোনা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। আত্মীয়র হাসপাতাল হওয়ায় কেবিন পেলেন।
আরেক নিকট আত্মীয় ক্যানসারের রোগী। সত্তরের ওপর বয়স। করোনা পজিটিভে। শ্বাসকষ্ট নিয়ে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে চেষ্টা করে ভর্তি হতে না পেরে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। এত এত মানসিক চাপের মধ্যে নিজেকে যথেষ্ট মানসিকভাবে শক্ত রেখে চলছিলাম।
এদিকে আমার ছেলেটা এই বিপর্যস্ত সময়ে কানাডায় একা। অনিশ্চিত মা–ছেলের দেখা হওয়া। ওর ভিসা প্রসেসিংয়ে থাকার কারণে দেশেও আসতে পারছে না।
এত কিছুর মধ্যে ৯ দিন ধরে আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ। প্রথমে চার দিন জ্বর ১০১। চার দিনে জ্বর কিছুটা কমতেই গলায় ভয়ানক ব্যথা। ওষুধ খেয়ে গলাব্যথা কমতে না কমতেই শ্বাস নিতে কষ্ট শুরু হলো। আর বুকে কিছুটা ব্যথা ও কাশি।
ভাপ নিচ্ছি, টোটকা খাচ্ছি (আদা, তেজপাতা, লবণ, লবঙ্গ, তুলসীপাতা ফুটিয়ে) সঙ্গে লেবুর রস ও মধু মিশিয়ে খাচ্ছি।
হাসপাতালে যাওয়ার কথা চিন্তাই করছিলাম না। একটু শ্বাসের সমস্যা কমতেই নাক বন্ধ। আবার চোখের পাতা ব্যথা ও লাল হয়ে গেল। এদিকে খাবারের কোনো স্বাদ–গন্ধ নেই। তবু এনার্জির জন্য জোর করে খাবার খাই।
এর মধ্যে নিজেই নিজেকে টেককেয়ার করি। ঘরের রান্নাও করি। স্বামীও রান্না করে দিলেন মাঝে শরীর বেশি খারাপ ছিল বলে আমার। বাসায় বলে রেখেছি, অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট হলে আমাকে হাসপাতালে নেবে না। আমি যতক্ষণ বাঁচি বাসায়ই সবার মাঝে থাকব।
ছেলেকে বলিনি নিজের শরীর খারাপের কথা। তবু তিন দিন আগে ফোনে কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করেছে, মা, তোমার কী হয়েছে? শরীর খারাপ?
আমি এই তো গলা বসে গেছে বলে এড়িয়ে গেলাম।
আজ বাধ্য হয়ে করোনা টেস্ট করাতে হাসপাতালে গেলাম। আবার হালকা জ্বর আর গলাব্যথাও যেন ঠিক হচ্ছে না। বাসায় আরও দুজনার জ্বর শুরু। নিজের পরিবারের দুশ্চিন্তার জন্য করোনা টেস্ট করাতে দিয়ে এলাম।
তবে এতটা দিন পরে বাইরে গিয়ে আমার কাছে মনে হলো আমরা বাঙালিরা আসলেই সাহসী জাতি। সবাই বউ–বাচ্চা নিয়েও সমানে রাস্তায় চলছেন। প্রায় সব চলছে, সবাই চলছে। হাসপাতালের পাশের মার্কেটে কেনাকাটার দৃশ্য দেখলাম। বৃদ্ধ দোকানদার মুদি দোকান চালাচ্ছেন। ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ রিকশা চালাচ্ছেন।
আমি হাসপাতালে যাওয়া–আসাসহ এক ঘণ্টা বাইরে ছিলাম। আবার সেই বাসার মধ্যে। এই যে এতটা দিন আমি ঘরের মধ্যে। আমার কিন্তু একটুও খারাপ লাগেনি। বড় ভাইকে দেখি না কত দিন। বন্ধুদের কাছে থেকে দেখি না। ছেলেকে দেখি না। এগুলো সহজে মেনে নিয়েছি। আমার শুধু মানুষের জন্য খারাপ লাগে। আমার ছেলেটার জন্য খারাপ লাগে। এখনো সব মানুষের জন্য দুশ্চিন্তা হয়।
তবে একটা বিশ্বাসের দৃঢ়তা আমার তা হলো আমরা সাহসী জাতি। ইনশা আল্লাহ আমরা সব ওভারকাম করব। আমার করোনা নেগেটিভ এলে তো আলহামদুলিল্লাহ। আর পজিটিভ এলেও কীভাবে আল্লাহর রহমতে সব সামলে নিচ্ছি, আপনাদের লিখে জানাব ইনশা আল্লাহ। সবাই সাবধানে থাকবেন, নিরাপদ থাকবেন, দোয়া করবেন। চলবে...
*আগামী পর্বে: করোনা পজিটিভ এল আমার
*মতিঝিল, ঢাকা