>শিক্ষা ও গবেষণায় এ প্রতিষ্ঠানের ওপর আমলাদের প্রভাবের কারণে এটি কোনো কাজ করতে পারছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
পৃথিবীর সব মাতৃভাষা সংরক্ষণ, গবেষণা ও বিকাশের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। তবে ১০ বছরে সেমিনার, নিউজ লেটার ও স্মরণিকা প্রকাশ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ নেই। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে করা একমাত্র কাজ ‘নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা’র একটি খণ্ডের কাজ শেষ হলেও এটি দুই বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন–২০১০ অনুযায়ী, এই ইনস্টিটিউটের ২৩টি দায়িত্বের কথা উল্লেখ আছে। তবে সেগুলোর বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। বিদেশে বাংলা ভাষার প্রসারে এই ইনস্টিটিউটের উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ নেই। মাতৃভাষা বিকাশে কাজ করা বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট শিক্ষা মন্ত্রণালয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে এর কোনো স্বাধীন সত্তা নেই। শিক্ষা ও গবেষণায় এই প্রতিষ্ঠানের ওপর আমলাদের প্রভাবের কারণে এটি কোনো কাজ করতে পারছে না বলে মনে করেন তাঁরা।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। সে লক্ষ্যে সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির উত্তর পাশে ১ দশমিক ৩ একর জায়গায় ২০০৩ সালের ৬ মে ১২ তলাবিশিষ্ট বিশাল ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। তবে জোট সরকারের সময় এই ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে ২০১০ সালে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এটি ছয়তলা পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে। এরপর ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।
একমাত্র বড় কাজ
১০ বছরে প্রতিষ্ঠানটির একমাত্র বড় আকারের কাজ ‘নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা’। বাংলাদেশের বসবাসরত বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ভাষা-পরিস্থিতি ও ভাষিক সম্প্রদায়ের অবস্থা ও অবস্থান জানার জন্য ২০১৩ সালে প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে এ সমীক্ষার কাজ শুরু হয়। ২০১৬ সালের জুন মাসে এ সমীক্ষার মাঠপর্যায়ের কাজ শেষ হয়। সমীক্ষার একটি খণ্ডের কাজ শেষ হয়েছে।
গবেষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্পূর্ণ কাজ শেষ করে ১০ খণ্ড বাংলা ও ১০ খণ্ড ইংরেজিতে বই আকারে প্রকাশ হতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে।
মহাপরিচালক অধ্যাপক জীনাত ইমতিয়াজ আলী বলেন, ‘নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার একটি খণ্ডের কাজ শেষ হয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছি। আরও দুই খণ্ড প্রকাশ হলে একসঙ্গে তিন খণ্ড প্রকাশ করা হবে।’
নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার পরামর্শক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার। তিনি বলেন, ‘নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার একটি খণ্ড ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে বই আকারে ছাপানো হয়েছে। তবে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দুই বছর ধরে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট তা জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি।’
দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করতে ইনস্টিটিউট ২০১৫ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা, ইউনেসকোর ক্যাটাগরি-২ ইনস্টিটিউটের স্বীকৃতি পেয়েছে।
গবেষক ও দক্ষ জনবল সংকট
ইনস্টিটিউটের জনবল কাঠামো অনুযায়ী ১৭টি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার পদসহ মোট ৯৮টি অনুমোদিত পদ আছে। তবে বর্তমানে ১১ জন কর্মকর্তা এবং ২৭ জন কর্মচারী এখানে কাজ করছেন। ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক জীনাত ইমতিয়াজ আলী বলেন, দাপ্তরিক কাজ করার জন্য সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা প্রেষণে কাজ করছেন। তাঁদের দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে।
দৃশ্যমান শুধু স্মরণিকা, নিউজ লেটার
মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন ও স্মরণিকা প্রকাশ করে। গত ১০ বছরে এখান থেকে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ নামে ইংরেজিতে প্রকাশিত পত্রিকা, বাংলায় মাতৃভাষা পত্রিকা, মাতৃভাষা বার্তার আটটি সংখ্যা, ইংরেজি নিউজ লেটার দুটি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ভালোবাসি মাতৃভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধের ব্রেইল প্রকাশনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের ইশারা ভাষায় অডিও ভিজ্যুয়াল প্রকাশনা করেছে। এ ছাড়া বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে কিছু প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা করেছে।
মাতৃভাষা পদকের খসড়া
একুশে ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশে বিশেষ অবদানের জন্য ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক’ দেওয়ার খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক সৌরভ সিকদার বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু দীর্ঘদিন পার হওয়ার পরও এই প্রতিষ্ঠান নিজের পায়ে সামর্থ্য নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের এখন একটাই কাজ, তিন মাস পরপর একটা বুলেটিন বের করা, বছরে একবার গবেষণার নামে জরিপ করা এবং একুশে ফেব্রুয়ারি এলে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করা আর দুদিনব্যাপী সেমিনার করা।
সৌরভ সিকদার বলেন, ‘মন্ত্রণালয় ও আমলাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এ প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন কোনো সত্তা নেই। এই প্রতিষ্ঠানকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান করতে হবে।’