‘মায়ের ডাক’–এর মানববন্ধন

হয় সন্ধান দেন, না হয় কবর কোথায় জানান

গুমের শিকার হওয়া ৪০ ব্যক্তির পরিবার স্বজনদের ফিরে পাওয়ার দাবিতে গতকাল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে শাহবাগে মানববন্ধন করে।

নিখোঁজ বাবার কথা বলতে গিয়ে কাঁদতে থাকে আদিবা ইসলাম। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত মানববন্ধনে মা ফারজানা আক্তারের (পেছনে) সঙ্গে এসেছে সে। ২০১৩ সালে গুম হন তার বাবা বংশাল থানা ছাত্রদল নেতা পারভেজ হোসেন। গতকাল বিকেলে শাহবাগ এলাকায়
ছবি: দীপু মালাকার

আদিবার বয়স তখন মাত্র দুই বছর। তত দিনে ‘বাবা’ ডাকতে শিখেছে সে। এরপর সে যত বড় হচ্ছে, বাবার অনুভূতি ততটাই তীব্র হচ্ছে তার কাছে। বাবা কোথায় জানতে এখন সে মাঝেমধ্যে মায়ের হাত ধরে মানববন্ধনে আসে। বাবা পারভেজ হোসেনের ছবি নিয়ে অন্যদের সঙ্গে গতকাল শুক্রবার বিকেলে আবিদা এসেছিল শাহবাগে জাদুঘরের সামনে।

আবিদা এখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। বাবাকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বুক ফেটে কান্না চলে আসে তার। যতটুকু বলেছে, তা অনেকটা এ রকম, ‘আমি আর চাই না এত কষ্ট কইরা পাপার (বাবা) ছবি নিয়ে দাঁড়াইতে। আমার কষ্ট হয়, আর ভালো লাগে না। মন চায় পাপাকে ধরে দাঁড়াইতে। পাপার ছবি ধরে দাঁড়াইতে মন চায় না। আমার পাপারে ফিরিয়ে দেন।’

সরকারের কাছে আহ্বান করেছিলাম, সন্তানের খোঁজ দিতে না পারলে কোথায় মাটি দেওয়া হয়েছে, তা জানানো হোক। অন্তত কবরের খবরটা জানাক, তাহলে ছেলের কবর জিয়ারত করতে পারব।
শফিকুর রহমান, নিখোঁজ ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়ে

আদিবা ইসলামের বাবা পারভেজ হোসেন বংশাল থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর শাহবাগ থেকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যায় পারভেজকে। গত আট বছরেও তাঁর আর কোনো খোঁজ নেই। তিনি বেঁচে আছেন না মরে গেছেন, এ নিয়ে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ কিছু বলতে পারছে না।

এ রকম গুমের শিকার হওয়া ৪০ ব্যক্তির পরিবার গতকাল বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করেছে। গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে এ কর্মসূচির আয়োজন করে।

মানববন্ধনে অন্যদের সঙ্গে এসেছিল কিশোরী আনিশা ইসলাম। তার বাবা মিরপুরের পল্লবী এলাকার কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন ২০১৯ সালের জুন মাসে নিখোঁজ হন। বাবার সন্ধান চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুতি জানিয়ে সে বলেছে, তার পরিবার র‍্যাবের হেডকোয়ার্টার, পুলিশ কমিশনার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। কিন্তু বাবার সন্ধান দিতে পারেনি কেউ।

ঢাকার একটি স্কুলে এখন নবম শ্রেণিতে পড়ে আনিশা। সে তার বাবার খোঁজ যেমন চায়, তেমনি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হোক এটাও চায়। মানববন্ধনে তার প্রশ্ন ছিল, স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও এমন পরিস্থিতি কেন?

এ মানববন্ধনে অংশ নেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের রামপুরা থানা শাখার সাবেক সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেনের স্বজনেরাও। তাঁর মা সালেহা বেগম কথা বলার সময় কাঁদছিলেন। পরে কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি তাঁর ছেলে গুম হন। ছেলেকে ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনবার দেখা করেছেন। আশ্বাস পেলেও ছেলেকে এখনো ফিরে পাননি। ছেলেকে ফিরে পেতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপি থেকে শুরু করে কোথাও যেতে বাদ রাখেননি বলে জানান তিনি।

মানববন্ধনে গুলশান থানা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি সাইফুর রহমানের বাবা শফিকুর রহমান নিখোঁজ ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়ে বলেন, ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভাটারা থানা এলাকা থেকে তাঁর ছেলে গুম হন। ছেলের সন্ধান চেয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছে আহ্বান করেছিলাম, সন্তানের খোঁজ দিতে না পারলে কোথায় মাটি দেওয়া হয়েছে, তা জানানো হোক। অন্তত কবরের খবরটা জানাক, তাহলে ছেলের কবর জিয়ারত করতে পারব।’ ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর শোকে ২০১৮ সালে তাঁর স্ত্রী পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

ছেলে রাজনীতি করেছে, এটাই কি অপরাধ—এমন প্রশ্ন রেখে শফিকুর রহমান বলেন, ‘তাহলে রাজনীতি বন্ধ করে দেন। আপনারাও রাজনীতি করবেন না। এ দেশে আর কোনো রাজনীতির দরকার নাই।’

গতকালের কর্মসূচিতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের ছবি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ান স্বজনেরা। তাঁদের মধ্যে এমন অনেক এসেছিল, যাদের বাবা গুম হওয়ার সময় হয় মায়ের কোলে ছিল, নয়তো কেবল হাঁটা শিখছিল।

এ কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলরের ফায়জুল হাকিম প্রমুখ।

গুম হওয়ার পেছনে যারা দায়ী, তাদের একদিন বিচারের মুখোমুখি হতে হবে বলে উল্লেখ করেন মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, সরকার নানাভাবে মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে।

আসিফ নজরুল বলেন, দেশের মানুষের অধিকারের কি অবস্থা, তা এসব বাচ্চা ছেলেমেয়ের কান্না দেখেই বোঝা যায়। এদের মধ্যে কেউ পিতা হারিয়েছে। কেউ পিতাকে চোখেও দেখেনি। কারও পিতার সঙ্গে সামান্য স্মৃতি আছে। অনেকের হয়তো বাবার স্মৃতি মুছে গেছে। প্রতিবছর দু–তিনবার অনুষ্ঠান করে তারা সবার সামনে কাঁদে। জীবনের অধিকার সবচেয়ে বড় অধিকার। সেই অধিকার তাদের পিতা বা স্বজনেরা পায়নি।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথ উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, জনগণের টাকায় এ প্রতিষ্ঠান রাখার কী দরকার। এ তথ্য কমিশন রাখার কী দরকার। এগুলো বিলুপ্ত করা হোক।

রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের অধিকার এখন হুমকির মুখে বলে মন্তব্য করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। বর্তমান সরকারের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সবাইকে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

ডাকসুর ভিপি নুরুল হক বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারগুলো এত নির্যাতন নিপীড়ন, দমন–পীড়নের পরও মানবাধিকার দিবস, গুম দিবসসহ বিভিন্ন দিবসে অনুষ্ঠান করছে এবং বিভিন্ন মত–পথের মানুষকে একত্র করছে। এভাবে চালিয়ে যেতে পারলে গুম হওয়া সদস্যদের ফেরত আনার পাশাপাশি দেশের মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করা সম্ভব হবে।

আয়োজক সংগঠনের সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন। আফরোজার ভাই সাজেদুল ইসলামকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর এখন পর্যন্ত তাঁর সম্পর্কে কিছু জানতে পারেনি পরিবার। মানববন্ধন সঞ্চালনা করেন মঞ্জুর হোসেন।

সভাপতির বক্তব্যে আফরোজা ইসলাম বলেন, দেশে মানবাধিকারের কী অবস্থা, তার জ্বলন্ত প্রমাণ নিয়ে তাঁরা মানববন্ধনে হাজির হয়েছেন। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার।