গত আট বছরে এ নিয়ে পঞ্চমবারের মতো প্রস্রাব সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন শাহিনুর আক্তার (৩৫)। প্রতিবারই কয়েক দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, ওষুধ খেয়ে ও কয়েক দিন পূর্ণ বিশ্রামে থেকে চাকরিজীবী এ নারীকে কাজে ফিরতে হয়। গতকাল শনিবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল দেখিয়ে নতুনভাবে ব্যবস্থাপত্র নিতে জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট এবং হাসপাতালে এসেছেন তিনি।
এই নারী প্রথম আলোকে জানান, তিনি মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। থাকেন মিরপুরের পল্লবীতে। প্রতিদিন যাতায়াতে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা সময় ব্যয় হয় রাস্তায়। প্রথমবার গর্ভধারণের সময়, আট বছর আগে, প্রথমবার প্রস্রাবে সংক্রমণ হয়।
শাহিনুর আক্তার বলেন, ‘সতর্ক থাকার চেষ্টা করি। তবে আমার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। আবার যাতায়াতের কারণে দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব আটকে রাখতে হয়। কোনটা থেকে যে অসুস্থ হই, বুঝি না।’
একই হাসপাতালে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া ও তলপেটে ব্যথা নিয়ে এসেছেন মেহবুবা খানম (২৯)। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে দেখে কয়েকটি পরীক্ষা ও দুই ধরনের ওষুধ লিখে দিয়েছেন। মেহবুবা একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। কাজের জন্য দিনের বেশির ভাগ সময় বাসার বাইরে থাকেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসার বাইরে শৌচাগার ব্যবহার করা হয় না। কোথায় আছে জানি না, আবার সেগুলো কেমন হবে ভেবেও যাওয়া হয় না।’ তবে এই হাসপাতালে অনেক পুরুষও প্রস্রাবের সংক্রমণ নিয়ে এসেছেন।
গত এক সপ্তাহে রাজধানীর কমপক্ষে ৫০ নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা সাধারণত গণশৌচাগার ব্যবহার করেন না। খুব প্রয়োজন হলে বা সঙ্গী পুরুষ থাকলে কেবল ব্যবহার করেন। এ জন্য অনেক নারী কোথাও যাওয়ার আগে থেকে পানি খাওয়া কমিয়ে দেন। অনেকে বাইরে খাবার খাওয়া বন্ধ রাখেন।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রস্রাবে সংক্রমণ একটি পরিচিত রোগ। যেকোনো বয়সীরা এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে শারীরিক গঠনের কারণে নারীরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। ঠিকমতো পানি পান না করা, দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব আটকে রাখা, অপরিচ্ছন্ন শৌচাগার ব্যবহার করা বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা না থাকার কারণে মূলত এ সমস্যা হয়।
পুরুষের তুলনায় নারীদের প্রস্রাবে সংক্রমণ বেশি হয় বলে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজি অ্যান্ড রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট ডিভিশনের প্রধান হাবিবুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মূত্রথলি ছোট, ধারণক্ষমতা কম। আবার মেয়েদের প্রস্রাব ও পায়খানার রাস্তা কাছাকাছি। ফলে দ্রুত ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালিতে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। তবে পানি কম খাওয়া ও দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখাও প্রস্রাবে সংক্রমণের বড় কারণ। তিনি আরও বলেন, বারবার প্রস্রাবে সংক্রমণ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এ সমস্যা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে কিডনি থেকে শুরু করে নানা শারীরিক জটিলতা হতে পারে। পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। পর্যাপ্ত পানি পান ও অন্তত চার ঘণ্টা পরপর শৌচাগার ব্যবহার করতে হবে।
ঢাকায় কমপক্ষে দেড় কোটি মানুষের বসবাস। এর একটি বড় অংশ নারী। আবার শহরে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। অথচ এই দুই সিটি করপোরেশনে ১২৯টি ওয়ার্ডে গণশৌচাগার আছে মাত্র ৬২টি। এর মধ্যে নতুন ৩৬টি ওয়ার্ডে কোনো গণশৌচাগার নেই। সব গণশৌচাগার আবার ব্যবহারের উপযোগী নয়।
এই শহরে কমপক্ষে এক হাজার গণশৌচাগার দরকার বলে জানান স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ মোবাশ্বের হোসেন। তিনি বলেন, হাঁটাপথে গণশৌচাগার থাকতে হবে। এতে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন কর্মজীবী নারীরা। তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমবে। পাশাপাশি বাইরের কাজে নারীরা আরও আগ্রহী হবেন।
শহরে গণশৌচাগার বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ওয়াটার এইড বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক রাজু বসাক প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা শহরের আয়তন বাড়ছে। যানজটের কারণে গাড়ির গতি কমায় মানুষ জানে না কখন গন্তব্যে পৌঁছাবে বা বাড়ি ফিরবে। এ জন্য কিছুদূর পরপর গণশৌচাগার প্রয়োজন।