পান্থকুঞ্জ পার্ক

স্বস্তির পার্ক অস্বস্তির কারণ

তিন বছর ধরে পার্কটি পরিত্যক্ত। সেখানে চলছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। আছে ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের আনাগোনা।

খুলে যাচ্ছে পান্থকুঞ্জ পার্কের টিনের বেড়া। গত সোমবার বিকেলে রাজধানীর কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ–সংলগ্ন এলাকায়
  ছবি: প্রথম আলো

তপ্ত রোদে ক্লান্ত পথচারীর বিশ্রামের জায়গা ছিল পান্থকুঞ্জ পার্কটি। ত্রিভুজাকৃতির এই পার্কে সকালে প্রবীণেরা ব্যায়াম করতেন। বিকেলে অনেকে সবুজের ছোঁয়ায় সময় কাটাতেন। কিন্তু এখন আর সেই পরিবেশ নেই। জঙ্গল হয়ে গেছে। এই অবস্থার নেপথ্যে একটি প্রকল্প।

২০১৮ সালে পার্কটি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) কর্তৃপক্ষ। এরপরই রাজধানীর ব্যস্ততম সোনারগাঁও মোড়ের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত পান্থকুঞ্জ পার্কের দুরবস্থার শুরু।

দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষ পার্কটির আধুনিকায়নে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে চারদিকে টিন দিয়ে এটিকে ঘিরে ফেলে। পরিকল্পনা ছিল এক বছরের মাথায় অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শেষে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া। কিন্তু কাজ শুরুর কয়েক দিন পর দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষ জানতে পারে, পার্কের এক পাশে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়ালসড়ক প্রকল্পের দুই থেকে তিনটি খুঁটি বসতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হয় উন্নয়নকাজ।

এভাবে প্রায় তিন বছর পার হলেও এখনো ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ পান্থকুঞ্জ পার্ক এলাকায় শুরুই হয়নি। দক্ষিণ সিটিও পার্কটি জনসাধারণকে ব্যবহার করতে দেয়নি। এখন সেখানে চলছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীরা এটিকে ‘ডেরা’ হিসেবে ব্যবহার করছে।

পান্থকুঞ্জ পার্কের উন্নয়নকাজের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন স্থপতি রফিক আজম। দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে একটা জায়গা এভাবে পড়ে থাকলে সেখানে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংগঠিত হওয়াটা স্বাভাবিক। পার্কটি আর আটকে না রেখে খুলে দেওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে মেয়রের সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি বলেন, বিদ্যমান অবস্থায় পার্কটিকে ব্যবহারের উপযোগী করা গেলে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কমবে। রাতে আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা করার পাশাপাশি ন্যূনতম খরচে পার্কটি ব্যবহারের উপযোগী করলে লোকজন এর সুফল পাবেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, পার্কটির চারপাশের কিছু কিছু জায়গায় টিন নেই। চাইলেই যে কেউ ভেতরে ঢুকতে পারে। তবে ভেতরে হাঁটার মতো পরিবেশ নেই। কোথাও কোথাও গর্ত করে রাখা হয়েছে। গর্তে জমে আছে পানি। পোকামাকড় গিজগিজ করছে। জন্মেছে আগাছা। জঙ্গলের মতো হয়ে গেছে। কিছু জায়গায় পাথরের স্তূপ। স্থানীয় লোকজন জানান, ভরদুপুরেও পার্কটিতে ঢুকলে গা শিউরে ওঠে।

হাঁটাপথ নির্মাণের জন্য মাটি খোঁড়া হয়েছিল। সেখানে জমে আছে পানি

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, পার্কের ভেতর অনৈতিক কাজ চলে। সন্ধ্যার পর ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটছে। খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগ এলাকার বাসিন্দা সাবিকুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, মাসখানেক আগে সন্ধ্যা সাতটার দিকে এই পার্কের পাশের রাস্তা হয়ে মিরপুরে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন। কারওয়ান বাজার মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে অপেক্ষার সময় ছিনতাইকারীরা তাঁর গলার অলংকার কেড়ে নেয়। তিনি গলায় প্রচণ্ড আঘাত পান। ছিনতাইকারীরা নিমেষেই পার্কের ভেতরে পালিয়ে যায়।

স্থানীয় বাসিন্দা কাজী মোকতার হোসেন বলেন, ‘নগরীতে অবসর কাটানোর জায়গা অনেক কমে গেছে। পার্কের উন্নয়নকাজে যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে, এর তো সমাধান করতে হবে। বছরের পর বছর ফেলে রাখার তো কোনো মানে হয় না। আমরা চাই, অবিলম্বে পার্কটি খুলে দেওয়া হোক।’

‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় পার্কটির সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছিল। এ জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় ১৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। পার্কটিতে মাটি–খোঁড়াখুঁড়ি ছাড়া তেমন কোনো কাজ না হলেও করপোরেশনের নথিতে গত মে মাস পর্যন্ত প্রায় ১৬ শতাংশ কাজ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে প্রায় ৯০ লাখ টাকা।

নগরীতে অবসর কাটানোর জায়গা অনেক কমে গেছে। পার্কের উন্নয়নকাজে যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে, এর তো সমাধান করতে হবে। বছরের পর বছর ফেলে রাখার কোনো মানে হয় না। আমরা চাই, অবিলম্বে পার্কটি খুলে দেওয়া হোক।
কাজী মোকতার হোসেন, স্থানীয় বাসিন্দা

জানতে চাইলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার প্রথম আলোকে বলেন, উড়ালসড়কের খুঁটি বসাতে পার্কের দক্ষিণ দিকে ২০ ফুটের মতো জায়গা লাগতে পারে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন চাইলে যেকোনো সময় পার্কটি জনগণের ব্যবহারের উপযোগী করে দিতে পারে।

পার্কটি ব্যবহারের উপযোগী না করার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুন্‌সী মো. আবুল হাসেম প্রথম আলোকে বলেন, এই পার্কের ওপর দিয়ে যেহেতু উড়ালসড়ক যাবে, তাই তাঁরা এর উন্নয়নকাজে সরকারি টাকা অপচয় করতে চাননি। তবে বিদ্যমান অবস্থায় এটি চালু করা যায় কি না, এ নিয়ে তাঁরা চিন্তাভাবনা করছেন।