স্বপ্ন মানুষকে সফল হওয়ার পথে এগিয়ে নেয়, তাই স্বপ্নকে কখনো বলি না দিতে তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন করপোরেট ব্যক্তিত্ব সোনিয়া বশির কবীর। মাইক্রোসফট বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, লাওস ও মিয়ানমারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোনিয়া বশিরের মতে, জীবনে জয় পেতে হলে ইতিবাচক মানুষ হতে হবে। আজ শনিবার বিএসআরএম-প্রথম আলো আয়োজিত ‘মিট দ্য এক্সপার্ট’–এর প্রথম পর্বে তরুণদের মুখোমুখি হয়ে এ কথা বলেন তিনি।
আয়োজনটা ছিল এমন, দেশের হাতে গোনা শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজনকে সামনে পেয়ে তরুণ মন প্রশ্ন করবে। সফল ব্যক্তির কাছে জেনে নেবেন সফলতার পেছনের মূলমন্ত্র। উজ্জীবিত হবেন নিজের পেশা জীবনকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিতে। বেশ যাচাই–বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে তাঁরা এভাবে সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছেন। তবে অনুষ্ঠানটি শুধু এমন একতরফা প্রশ্নোত্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। আমন্ত্রিত অতিথি সোনিয়া বশির কবীর নিজেও তরুণদের প্রশ্ন করে তাঁদের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা, হতাশার কথা জেনে নিয়েছেন। অনেকের সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছেন নিজের জীবনেরও।
আজ ‘মিট দ্য এক্সপার্ট’–এর প্রথম পর্বটি শুরু হলো সোনিয়া বশির কবীরের মুখোমুখি ১০ জন উদ্যমী তরুণদের নিয়ে। অনলাইনে দেড় হাজার আবেদনপত্রের মধ্যে যাচাই–বাছাই করে এই তরুণদের এ আয়োজনের জন্য নির্বাচিত করা হয়।
তরুণদের উদ্দেশে অনুষ্ঠানে সোনিয়া বশির বলেন, স্বপ্নটাকে কখনো স্যাক্রিফাইস (বলি) করে দিয়েন না। ক্যারিয়ারের যাত্রায় ভয়কে জয় করে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগোতে হবে। এই যাত্রায় ব্যর্থ হবেন, পড়ে যাবেন, আবার উঠে দাঁড়িয়ে পথ চলতে শুরু করবেন, পেছনে ফিরে আসবেন না।
গুলশানের শেফ’স টেবিলে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি শুরু হয় সকাল নয়টায় ‘একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সকালের নাশতার’ থিম নিয়ে। প্লেট থেকে খাবার মুখে তুলে আর জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে অন্তরঙ্গ পরিবেশে চলে আলোচনা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আমরাই বাংলাদেশের সহপ্রতিষ্ঠাতা আরিফ আর হোসেন। অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি কথা হয়, সমালোচনায় নিরুৎসাহিত না হয়ে নিজের স্বপ্নটাকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি।
অনুষ্ঠানে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর ছাত্রী নুসরাত জাহান, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শেষ বর্ষের ছাত্রী এরিকা আফরিন বুশরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্রী সারাহ তামান্না, বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের (বিএম কলেজ) মার্কেটিং তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী শারমিন আক্তার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সফটওয়ার্কস লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক নীতা বর্মণ, চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ফয়সাল মেহেদী, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মাহামুদুল হাসান আসিফ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির বিবিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র নাফিস সাদিক চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএর ছাত্র মোহাম্মদ তানসেন এবং রাজশাহীর গণিত শিক্ষক মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা ও এরিকা আফরিনের প্রশ্ন ছিল সোনিয়া বশির নিজেকে সফল মনে করেন কি না? এর জবাবে তিনি বলেন, তাঁর কাছে সফলতার সংজ্ঞা হচ্ছে, মন থেকে যা করতে চেয়েছেন, তা করতে পেরেছেন কি না। নিজেকে এখনো পুরোপুরি সফল বলে মনে করেন না। কারণ, ইচ্ছে অনুযায়ী অনেক কিছু করার বাকি রয়েছে এখনো। দেশের প্রতিটি এলাকা ডিজিটাইজেশনের সুবিধায় আনার লক্ষ্যে কাজ করছেন। সে স্বপ্ন পূরণ করতে চান।
মাসুদ রানা তরুণদের জন্য সোনিয়া বশিরের পরামর্শ জানতে চান। জবাবে সোনিয়া বশির বলেন, স্বপ্নটাকে কখনো বলি দিয়েন না। স্বপ্নের পথে অনেকে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, সেসব বাধা ডিঙিয়ে এগোতে হবে।
নিজের আত্মবিশ্বাসের কথা বলতে গিয়ে এই তরুণ বলেন, ‘কোনো কাজ শুরুর আগে কারও কাছে পরামর্শ নিতে গেলে দেখেছি তাঁরা নিরুৎসাহিত করেন। তাই ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখে রেখেছি, যেখানে যাব বস হব। আমার জীবনে অন্যের বলার দিন শেষ। এখন আমি বলব, অন্যরা শুনবে।’ তাঁর ওই কথায় সায় দেন সোনিয়া বশির।
নীতা বর্মণ জানান, সন্তান নিয়ে কর্মস্থলে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে কত যুদ্ধ করতে হয়েছে। সেসব পরিস্থিতির কথা ভাবলে আরেকটি সন্তান নিতে তাঁর ভয় হয়। তিনি জানতে চান, সোনিয়া বশির কীভাবে সব সামাল দিয়ে সফল হয়েছেন?
নিজেও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে লড়াই করে টিকেছেন মন্তব্য করে সোনিয়া বশির বলেন, একই সমস্যায় তিনিও পড়েছেন। সন্তানদের সময় দিতে পারেননি। এ নিয়ে ছোটবেলায় সন্তানেরা অভিমানও করেছে। নিজের মায়ের কাছেও বকা শুনেছেন। কিন্তু এখন সন্তানেরাই তাঁর পাশে। যে মেয়ে ছোটবেলায় মাকে না পেয়ে গাল ফুলাত, সেই মেয়ে এখন বড় হয়ে নিজেই ক্যারিয়ারকে আত্মবিশ্বাস অর্জনের ক্ষেত্র বলে মনে করেন। তিনি বলেন, নারীকে ক্যারিয়ারের যাত্রায় ভয়কে জয় করে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগোতে হবে।
নারী-পুরুষের বেতনবৈষম্যের কথা তুলে ধরেন সারাহ তামান্না। এ ক্ষেত্রে নারীকে চাকরি নেওয়ার সময় বেতনভাতা নিয়ে কণ্ঠ সোচ্চার করার পরামর্শ দেন সোনিয়া বশির। তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, নারীরা চাকরি পেয়েই খুশি হয়ে যান, বেতন নিয়ে মাথা ঘামান না। এতে নিয়োগকর্তাও পেয়ে বসেন। এদিক দিয়ে পুরুষ চাকরিপ্রার্থীরা অনেক বেশি সচেতন।
বরিশালের শারমিন জানান, প্রসাধন খাতে তাঁর আগ্রহ বেশি। সব সময় চেয়েছেন নিজস্ব একটি বিউটি পারলার। কিন্তু নিজের বাবা-মাও এতে বাধা দিয়েছেন। বাবা-মা চান তিনি পড়াশোনা শেষ করে ‘ভালো চাকরি’ করেন। বিয়ের পর শাশুড়ির সহায়তায় একটি পারলার গড়ে তুলেছেন। কিন্তু অনেকে এমন মন্তব্য করেন, পড়াশোনা করে তিনি কেন অন্যের চুল কাটেন। এসব মন্তব্যে প্রায়ই ব্যথিত হন।
কয়েকজন তরুণ বললেন, তাঁরা অনেক কিছুতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। কেউ কেউ নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে ভাবেন, কিন্তু তাতে মনোনিবেশ করতে পারেন না, অনেকে বুঝতে পারেন না কোনটা তাঁদের জন্য ভালো, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন।
সোনিয়া বশির বলেন, প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন সমস্যায় ভোগেন। যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে আগে নিজেকে ভাবতে হবে কিসে তিনি আলোকপাত করতে চান। সেই হিসেবে কাজে মনোনিবেশ করতে হবে। এখন অনেক তরুণ অনেক বেশি দুশ্চিন্তায় ভোগেন। এত বেশি দুশ্চিন্তায় ভুগলে হতাশা এসে গ্রাস করার আশঙ্কা রয়েছে। সব সময় ইতিবাচক থাকতে হবে। যাঁদের পেশাজীবনে প্রবেশের সময় এসেছে, তাঁদের জন্য নেটওয়ার্কিং গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মায়ের উদ্দেশে তিনি বলেন, সন্তানের ইচ্ছা, স্বপ্নকে প্রাধান্য দিন।
নুসরাত জাহানের এক প্রশ্নের জবাবে সোনিয়া বশির বলেন, ‘জীবনে অনেকবার ব্যর্থ হয়েছি। যতবার পড়েছি, ততবার উঠেছি। নিজেকে সব সময় বলেছি, যতবার পড়ব, ততবার আরও বেশি করে উঠে দাঁড়াব।’ তিনি বলেন, জীবনে ধাক্কা আপনি খাবেনই। যত তাড়াতাড়ি ব্যর্থ হবেন, তত তাড়াতাড়ি শিখবেন। তত তাড়াতাড়ি আবার ‘রেসে’ নামবেন।