বেলা ১১টা ২০ মিনিট। রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাতি শাখার ছুটি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা একে একে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু স্কুলের মূল ফটকের সামনেই অভিভাবকদের জটলা আর গাদাগাদি।
অভিভাবকদের একটা অংশের এই গাদাগাদি দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অন্য অভিভাবকেরা। তাঁরা বলছেন, স্কুলে পাঠাতে ও স্কুলের ভেতরে যে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে, স্কুলের বাইরে বেরোলেই তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে।
এদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষ বলছে, শিক্ষার্থীদের স্কুলে নিয়ে আসতে এবং স্কুল ছুটির পর বাসায় পৌঁছাতে অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে।
দীর্ঘ দেড় বছর পর সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে গতকাল রোববার। আজ সোমবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দ্বিতীয় দিন। রাজধানীর মতিঝিল, আরামবাগ ও শাজাহানপুরে ছয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুলে ঢোকানো হচ্ছে। স্কুল প্রাঙ্গণে অযথা কোনো শিক্ষার্থীকে ঘুরতে দেওয়া হচ্ছে না। শ্রেণিকক্ষগুলোতেও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক নিশ্চিত করছেন শিক্ষকেরা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা–কর্মচারীরাও মাস্ক ব্যবহার করছেন। তবে স্কুল ছুটির পর শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে গেলে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে দেখা যাচ্ছে না।
গোড়ানের বাসিন্দা সেলিম খানের দুই সন্তান পড়ছে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। একজন অষ্টমে, অন্যজন ষষ্ঠ শ্রেণিতে। সন্তানদের বাসায় নিয়ে যেতে তিনি স্কুলের মূল ফটকের জটলা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্কুল ছুটির পর শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে বের হচ্ছে। কিন্তু গেটের সামনে অভিভাবকেরা গাদাগাদি করে আছেন। অভিভাবকেরা যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানেন, তাহলে বিপদ হতে পারে। অভিভাবকদের এ বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া উচিত।
আরেক অভিভাবক শামসুল আলমের মেয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ছে। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকার সঠিক নিয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। কিন্তু অভিভাবকদের এ ধরনের জটলা করার কোনো প্রয়োজন নেই। স্কুল কর্তৃপক্ষ ছুটির সময় মাইকিং করলে ভালো হতো।
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, গতকাল স্কুল শুরুর প্রথম দিনে গড় উপস্থিতি ছিল ৭৫ শতাংশ। আজ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ৭৪ শতাংশ। স্কুলে ঢোকার সময় তাপমাত্রা মাপা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা এবং দূরত্ব রেখে আসনে বসানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। আজ তৃতীয়, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও দশম শ্রেণির ক্লাস হচ্ছে।
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. মোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, স্কুলে এসে কোনো বাচ্চার শরীরে তাপমাত্রা বেশি বা অসুস্থ হয়েছে—এমনটি গত দুদিনে পাওয়া যায়নি। অসুস্থ থাকলে অভিভাবকেরাই ফোন দিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছে। স্কুল শুরুর আগে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে। তবে স্কুল ছুটির পর মূল ফটকের সামনে অভিভাবকদের জটলা থাকছে। রশি টেনে শিক্ষার্থীদের বের করা হচ্ছে। বিএনসিসি সদস্য, নিরাপত্তাকর্মী ও স্কুলের কর্মীরা এসব দায়িত্ব পালন করছেন।
স্কুল ছুটির পর একই চিত্র দেখা গেল মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়, মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, মতিঝিল কলোনি উচ্চবিদ্যালয় ও নটর ডেম কলেজে।
মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তামান্না হক বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা ক্লাসে খুব ভালো মনোযোগ দিচ্ছে। দীর্ঘ বিরতির পর ক্লাস শুরু হয়েছে বলে তাদের পড়ার চাপ কম দেওয়া হচ্ছে। কোন কোন শিক্ষার্থী কিছুক্ষণ দম নেওয়ার জন্য মাস্ক খুলে ফেলছে। বলছে অস্বস্তি লাগে। আমরা তাদের সতর্ক করে দিচ্ছি।’
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আজ দ্বিতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস ছিল। দ্বিতীয় শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থী ২৩৩। তবে উপস্থিত ছিল ১৩২ জন। আর পঞ্চম শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থী ২৪৭, উপস্থিত ছিল ১৩৯ জন।
অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের প্রসঙ্গে মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরজাহান হামিদা প্রথম আলোকে বলেন, অনেক শিক্ষার্থীই পরিবারের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে আছে। খুব কম শিক্ষার্থী অসুস্থ বলে আসতে পারছে না। গত দুদিন এই স্কুলে এসে অসুস্থ হয়েছে—এমন শিক্ষার্থী পাওয়া যায়নি।
নটর ডেম কলেজে দুপুর ১২টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, সকালের পালার ক্লাস শেষে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসছে। তবে তাদের অনেকের মুখের মাস্ক থুতনিতে নামানো। কারও কারও মুখে কোনো মাস্ক নেই। অথচ সকালে কলেজে ঢোকার সময় কাউকে মাস্ক ছাড়া ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
নটর ডেম কলেজ কর্তৃপক্ষ অবশ্য মাস্ক ছাড়া কলেজে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। দুপুর ১২টার দিকে কলেজের মূল ফটকের সামনে গিয়ে দেখা যায়, দুপুরের পালার শিক্ষার্থীরা কলেজে ঢুকছে। ভেতরে ঢোকার সময় প্রত্যেককে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেওয়া হচ্ছে। এরপর থার্মাল যন্ত্রে শরীরের তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। তারপর শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের দিকে চলে যাচ্ছে।
নটর ডেম কলেজের ছাত্র পরিচালক ফাদার অ্যান্থনি সুশান্ত গোমেজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মানানোর বিষয়টিতে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। কলেজ প্রাঙ্গণে ভেতরে কোনো শিক্ষার্থী মুখের মাস্ক নামিয়ে নিলে আমাদের কর্মকর্তারা তাদের সতর্ক করে দিচ্ছে। তবু কোনো কোনো শিক্ষার্থী মাস্ক না পরে ঘোরাফেরা করার চেষ্টা করছে।’