বছিলা

সেতু আর সড়ক বদলে দিল সব

শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতুর দুই পাশে বছিলার গ্রামীণ চেহারা বদলে গেছে। গড়ে উঠছে অসংখ্য বহুতল ভবন। গতকালের ছবি। প্রথম আলো
শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতুর দুই পাশে বছিলার গ্রামীণ চেহারা বদলে গেছে। গড়ে উঠছে অসংখ্য বহুতল ভবন। গতকালের ছবি।  প্রথম আলো

মাত্র এক-দেড় দশকেই বদলে গেছে সবকিছু। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, যাতায়াতব্যবস্থা, প্রাকৃতিক পরিবেশ সবকিছু পাল্টে বছিলার মাটির রাস্তার জায়গায় এখন পিচঢালা পথ, সড়কবাতির আলোয় গ্রামীণ পটভূমির বদলে পুরোদস্তুর শহুরে পরিবেশ। সম্প্রতি পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন।

বেড়িবাঁধ চৌরাস্তা থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু পর্যন্ত বুড়িগঙ্গাপাড়ের এলাকাটি বছিলা নামে পরিচিত। এই সেতুকে বছিলা ব্রিজ বা তৃতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু নামেও ডাকা হয়, যা মোহাম্মদপুরের সঙ্গে কেরানীগঞ্জকে যুক্ত করেছে। বছিলার বাসিন্দারা বলছেন, এই সেতু আর বেড়িবাঁধ চৌরাস্তা থেকে শুরু হওয়া সংযোগ সড়কটিই বছিলার খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রেখেছে। সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হতেই এলাকাটি বিভিন্ন বেসরকারি আবাসন কোম্পানির নজরে আসে। ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটি উদ্বোধন করেন। বর্তমানে বেড়িবাঁধ চৌরাস্তা থেকে সেতু পর্যন্ত সড়কের দুই পাশের নিম্নভূমি ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে অন্তত ১০টি আবাসিক এলাকা। এ ছাড়া সেতুর নিচে দুই পাশে বছিলার আদি বসতিস্থল দক্ষিণপাড়া, উত্তরপাড়া ও মধ্যপাড়াতেও লেগেছে নগরজীবনের ছোঁয়া।

গতকাল শুক্রবার ঠিক সেতুর নিচে বছিলা পুরোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে কথা হচ্ছিল এখানকার ব্যবসায়ী মনির হোসেনের সঙ্গে। বয়স প্রায় ৫০ বছর। বছিলাতেই বড় হয়েছেন। পরিবর্তন দেখেছেন চোখের সামনেই। তিনি বলেন, যে গতিতে এই এলাকার পরিবর্তনগুলো হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। ১০-১৫ বছর আগেও এখানকার যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা। বুড়িগঙ্গা থেকে রায়েরবাজার খাল ধরে মোহাম্মদপুরে যেতে হতো। এখন এগুলো কিছুই বোঝার উপায় নেই। এই উন্নয়ন এলাকাবাসীর জন্য কতখানি ইতিবাচক ফল এনেছে, জানতে চাইলে মনির বলেন, গ্রামটি ঢাকার খুব নিকটবর্তী হলেও যোগাযোগ খুব সহজ ছিল না। বুড়িগঙ্গা নদী আর বিল মিলিয়ে গ্রামটি ছিল অনেকখানি দ্বীপের মতো।

বছিলা এলাকাটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। এলাকাবাসী জানান, দুই বছর আগে ডিএনসিসির পক্ষ থেকে নাগরিক সুবিধায় পিছিয়ে থাকা বছিলায় সড়কবাতির খুঁটি ও নতুন বাতি লাগানো, সড়কে পানিনিষ্কাশনের নালা তৈরি ও সড়ক সংস্কার, বাসাবাড়ি থেকে সংগ্রহ করা ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য একটি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) বানানো হয়েছে। দক্ষিণপাড়ার ২৪০ মিটার সড়কে পানিনিষ্কাশনের নালা তৈরি করা হয়েছে। সংস্কার করা হয় বুদ্ধিজীবী সেতুর নিচ দিয়ে বছিলায় প্রবেশের ভাঙাচোরা প্রধান সড়কসহ ভেতরের অনেকগুলো সড়ক।
উত্তরপাড়ার বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, সড়কবাতি বসায় এলাকায় যাতায়াতে সুবিধা হয়েছে। সন্ধ্যার পর গলির ভেতর আলোকিত হওয়ায় এলাকার নিরাপত্তাও বেড়েছে।

তবে বছিলায় নানা অবকাঠামোগত উন্নয়ন কিংবা নাগরিক সুবিধার সম্প্রসারণ হলেও এলাকার মানুষের মধ্যে কিছু বিষয়ে খেদ রয়ে গেছে। মধ্যপাড়ার ইকরামুল হক যেমন বললেন, নতুন অধিকাংশ আবাসিক এলাকায় খেলার মাঠ নেই। এ ছাড়া আবাসিক এলাকাগুলোর কারণে মাছপোড়া খাল, উত্তরপাড়ার খাল ও রায়েরবাজার খালের অবস্থা এখন বিপন্ন।
জসীমউদ্দীন নামের বছিলার আরেক বাসিন্দা আক্ষেপ করে বললেন, ‘আগে বছিলায় লোকসংখ্যা কমছিল। এখন অনেক মানুষ। সুবিধাও বেড়েছে। কিন্তু মানুষে মানুষে সেই সম্পর্ক নাই। সব কেমন ছাড়া ছাড়া। আগে খালে মাছ ধরছি, নদীতে গোসল করছি। ওই দিনগুলার কথা মনে হইলে মনে দুঃখের ভাব জাগে।’

সম্প্রতি বছিলায় ঢাকার নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) নিয়ে আয়োজিত এক পর্যালোচনা সভায় এখানকার আবাসন প্রকল্পগুলোতে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিধিমালা ভঙ্গের অভিযোগ করেন এলাকার অনেক বাসিন্দা ও এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। সেই সঙ্গে বছিলা গার্ডেন সিটি ও মোহাম্মদপুর ফিউচার টাউন লিমিটেডের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া দুটি খালের দখল হয়ে যাওয়া অংশগুলো পুনরুদ্ধারে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হওয়ার তাগিদ দেন তাঁরা।

এ বিষয়ে নতুন ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার পশ্চিমাংশে নগর সম্প্রসারণের জন্য বছিলা এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই এখন থেকেই যদি পরিকল্পিত উপায়ে এলাকাটি গড়ে তোলা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এর জন্য মূল্য দিতে হবে। এ ছাড়া বছিলা সেতু থেকে মোহাম্মদপুরের দিকে আসতে-যেতে একাধিক বিকল্প সড়ক তৈরির তাগিদ দেন তিনি।