সায়মাই তো নেই, কী হবে বাড়ি গিয়ে?

পরির মতোই সাজতে চাইত সায়মা। তাই ঈদের জন্য এমন পোশাক কিনেছিলেন মা। ছবি: হাসান রাজা
পরির মতোই সাজতে চাইত সায়মা। তাই ঈদের জন্য এমন পোশাক কিনেছিলেন মা। ছবি: হাসান রাজা

গ্রামের বাড়ি যাওয়া খুব শখ ছিল সায়মার। গেল ঈদে বাবা নিয়ে যাননি। ঈদে বাড়ি যেতে না পেরে সে কী কান্না মেয়েটার! বাবা কথা দিয়েছিলেন, কোরবানির ঈদে সবাই মিলে গ্রামের বাড়ি যাবেনই। 

কিন্তু হায়! এবারের ঈদেও বাড়ি যাওয়া হবে না সামিয়া আফরিন সায়মার। সে চিরতরে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। তার দেখা মিলবে না কোনো আয়োজনে, উৎসবে। সামিয়ার বাবা, মা, ভাই, বোনদের কাছে এবার ঈদের আনন্দ নেই। আছে দীর্ঘশ্বাস, ব্যথাতুর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ।

রোববার রাত ফুরালেই কাল সোমবার ঈদ। চারদিকে ঈদের ব্যস্ততা, উৎসবমুখর পরিবেশ। কিন্তু শনিবার দুপুরে ওয়ারী বনগ্রামের বাসায় সায়মাদের তেমন কিছুই ছিল না। সে বাসায় কবরস্থানের নীরবতা। সায়মার মা সানজিদা আক্তার ডুকরে ডুকরে কাঁদেন সেখানে। ছোট ছোট জামায় সায়মার গন্ধ মাখা, খেলনায় তার ছোঁয়া লেগে আছে। মেয়ের বই–খাতা, ঈদের জামা, পুতুল আর মেয়ের স্মৃতি বারবার মায়ের কান্নার কারণ।

গত ৫ জুলাই সন্ধ্যার পর সায়মাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। আর ঘটনাটি ঘটে সায়মাদেরই ভবনেরই একটি ফ্ল্যাটে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হারুন অর রশিদ ধর্ষণ ও হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

সায়মা চলে গেছে, ৩৬টি দিন চলে গেল। এত দিন সানজিদা আক্তার ঘর থেকে বের হননি। তাঁর ছয় বছরের মেয়েটি আজিমপুরের সবুজ মাটির বিছানায় চিরঘুমে। বাসা থেকে সেখানকার অনতিক্রম দূরন্ত। নিজের শোয়ার ঘরের বিছানায় ঘুমাতে পারেন না সায়মার মা। ছোট্ট জীবনকালে এই বিছানায় ঘুমাত মা–বাবার সঙ্গে।

শনিবার দুপুরে সায়মার মা খুব বেশি কথা বলতে পারেননি, যতটা বলেছেন তার বেশি কেঁদেছেন। সায়মার বাবা আবদুস সালাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এভাবেই চলছে আমাদের। আমাদের পরিবারের সব সুখ, আনন্দ শেষ করে দিয়েছে পশুটা। ওর মাকে সামলাতে পারি না, বোঝাতে পারি না। প্রতিদিন সন্ধ্যা হলে সামিয়ার মা কাঁদতে থাকে। তখন আমরা সবাই ওর পাশে বসে থাকি। ওকে সময় দিই। ঘুমের ওষুধ খেয়েও রাতে ঘুমায় না। বলে, মেয়েটা একা একা কেমনে ঘুমাচ্ছে অন্ধকার ঘরে।’

প্রতি ঈদে সায়মারা নরসিংদী শিবপুরের ইটনা গ্রামে যেত, দাদার বাড়িতে। সায়মার জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে গ্রামের প্রতি টান বাড়তে থাকে। গেলবার (রোজার ঈদে) যাওয়া হয়নি। একটি কারণ যানজটে ভয়। তার ওপর মাত্র চার মাস আগে বনগ্রামে নিজেদের ফ্ল্যাটে আসেন তাঁরা। সেটি গোছগাছের ব্যাপার ছিল। বাড়ি না যেতে পেরে সায়মার কান্না থামে না। শেষে বাবা কথা দেন, কোরবানির ঈদে বড় একটা গরু কিনবেন, সবাই মিলে বাড়িতে ঈদ করবেন। অগ্রিম বেশ কিছু নতুন জামাও কেনা হয়েছে।

নতুন জামাগুলো পরা হয়নি সায়মার। হবে না। সেই জামাগুলো এখন বারবার সায়মার মায়ের চোখের পানিতে ভেজে। শুকায়। আবার ভেজে। ঘুমাতে গেলে, খেতে গেলে শুধু সায়মার কথা মনে পড়ে তাঁর।

বেশ গোছানো নারী সানজিদা আক্তার। নতুন ফ্ল্যাটটা সাজিয়েছিলেন মনের মতো। নিজেই জানালেন, প্রতিবার ঈদ এলে ঘরে নতুন পর্দা টাঙান। বেডশিট কেনেন। ফ্রিজ খালি করে পরিষ্কার করেন। ভেতরে, বাইরে। বুয়া করেন, তবে নিজের না করলে মন ভরে না। তাই ঈদ এলে ধোয়ামোছার কাজ নিজেই করতেন। এসব কাজে ছোট্ট সায়মাও মায়ের সঙ্গে থাকত। চটপটে মেয়েটা। মানুষের সঙ্গে সহজে মিশে যেত। দেখা যেত, ঘরে কোনো অতিথি এলে নিজেই ফ্রিজ খুলে ফল বের করে নিয়ে যেত। কোথায় পেলে? মা প্রশ্ন করলে সায়মা বলত, ‘তুমি রাখার সময়ে দেখেছিলাম।’ সেই সায়মার অনুপস্থিতি ঈদ প্রস্তুতির দীর্ঘদিনের রীতি বদলে গেছে সানজিদা আক্তারের। একবারের জন্যও ফ্রিজ পরিষ্কার করার চিন্তা মাথা আসেনি এবার। ফ্রিজ খালি আছে না ভরা, সেটাও জানেন না তিনি।

গেল বছর জন্মদিনে চায়নিজে যাওয়া হয়নি। এ নিয়ে খুব গাল ফুলিয়েছিল মেয়েটা। ঘটনার আগের দিনও বাবাকে বলেছিল, ‘অনেক দিন চায়নিজে নাও না আব্বু। নিয়া যাইও।’ বাবাও কথা দিয়েছিলেন। উপহারের প্রতিও দারুণ আগ্রহ ছিল। বড় বোনের বান্ধবীরা বোনকে নানা সময়ে উপহার দিত। সায়মার বন্ধুরা কেন দেয় না, এ নিয়েও অনুযোগ। বলত, ‘আপুর বন্ধুরা গিফট দেয়, আমার বন্ধুরা দিতে দেয় না কেন।’ ভাইবোনেরাও খুব স্নেহ করতো পরিবারের ছোট্ট সদস্যকে।

ছবি তুলতে খুব পছন্দ করত সায়মা। মোবাইলে কেউ ছবি তুলতে গেলে ছোট্ট মুখটা এগিয়ে দিত। লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল। তবে শেষ দিকে খুব অস্থির ছিল। পড়তে চাইত না। পড়তে বসতে বললে বলত, ‘কী পড়ব। আমি এত কষ্ট করতে পারব না।’ কেন যে এমন করত, কেন যে এত ছবি তুলতে চাইত বুঝতাম না। পোলাও, চাইনিজ খাবার, আইসক্রিমের প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। মাকে বলত, মা, আমার না গরুর কুরকুরে মাংস খেতে খুব ভাল লাগে। মেয়ের কথা বলতে বলতে কিছুক্ষণ পরপর বুকচাপা আর্তনাদে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছিল শনিবার দুপুরে।

আরও পড়ুন:
ছোট্ট সায়মার মাথার ওপরেই ছিল ‘ধর্ষকের’ বাস