আজ ঘোষণা করা হয়েছে স্বাধীনতা পদক। এ বছর ১০ ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে। তবে সবাইকে ছাপিয়ে এ বছর সাহিত্যে যিনি পুরস্কার পেয়েছেন, সেই মো. আমির হামজাকে নিয়েই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে জোর আলোচনা। সবার একটিই জিজ্ঞাসা, কে এই মো. আমির হামজা?
আপনি যদি আমির হামজার নামটি প্রথমবারের মতো শুনে থাকেন, তবে জেনে রাখুন, মাত্র দুটি বইয়ের বদৌলতে আমির হামজার ললাটে জুটেছে আজ সাহিত্য শাখায় দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারটি। আরও চমকপ্রদ তথ্য হলো, মো. আমির হামজার দুটি বই ‘বাঘের থাবা’ ও ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’ বের হয়েছে ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে।
২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ৮৭ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত সমস্যায় আমির হামজা যখন মারা যান, তখন ‘বাঘের থাবা’ নামে কবিতা ও গানের এই বই তিনি কেবল দেখে যেতে পেরেছেন।
তবে এই দুটি বইও আবার এক বছরের ব্যবধানে বের করা হয়েছে একাধিক প্রকাশনী থেকে। ২০১৮ সালে ‘বাঘের থাবা’ নামে আমির হামজার যে বই বের হয়, তার প্রকাশক ছিল মাগুরার শ্রীপুরের সারথি ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আর বইয়ের মুদ্রণ ব্যবস্থাপনায় ছিল ঝিনাইদহের বেগবতী প্রকাশনী। তখন আমির হামজার মেজ ছেলে মো. আসাদুজ্জামান ছিলেন ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। বর্তমানে তিনি উপসচিব। খুলনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী হিসেবে কর্মরত। তিনি জানান, ‘ঝিনাইদহে চাকরি করার সময় ২০১৮ সালের বইমেলার সময় প্রথমে আমরা ‘বাঘের থাবা’ বইটি সারথি ফাউন্ডেশন থেকে বের করি। পরে ২০১৯-এ এই বইয়ের গান অংশটুকু “পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি” এবং কবিতা অংশটুকু “বাঘের থাবা” নাম দিয়ে আলাদা দুটি বই হিসেবে আবার বের হয় অন্যপ্রকাশ থেকে।
পরে ২০২১ সালে ‘একুশের পাঁচালি’ নামে আমির হামজার আরও একটি বই বের হয়েছে বলে তাঁর ছেলে জানান।
মো. আমির হামজার জন্ম ১৯৩১ সালের ৩ মে, মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার বরিশাট গ্রামে। গত শতকের ষাট দশক থেকে আশির দশক অবধি তিনি পালাগান, কবিগান করতেন বলে শ্রীপুরের স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। অবশ্য তাঁর ছেলে আসাদুজ্জামান তাঁর বাবাকে কবিয়াল বিজয় সরকারের শিষ্য বলে দাবি করেছেন। ছয় ছেলে ও তিন মেয়ের জনক আমির হামজা ব্যবসা ও কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরে আকবর হোসেনের নেতৃত্বাধীন ‘আকবর বাহিনী’র একজন যোদ্ধা ছিলেন।
জীবদ্দশায় আমির হামজার কোনো লেখা সেভাবে কোথাও কোনো মানসম্মত জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি বলে জানা যায়।
এর সূত্র ধরে আমির হামজার গ্রামের কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, তাঁকে স্বাধীনতা পদকের ‘যোগ্য’ করে তোলার জন্যই ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তড়িঘড়ি করে এসব বই বের করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন একজনের ভাষ্য, ‘২০১৮-এর পর থেকে দেখলাম আমির হামজার ছেলে আসাদ তাঁর বাবার বই বের করা নিয়ে খুব তোড়জোড় করছেন, একের পর এক বই বের করছেন। তখন ভেবেছিলাম, হয়তো বাবার বই ছেলের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কাজে লাগবে, তাই এমন করছেন। কিন্তু এখন দেখি ঘটনা অন্য।’
কিন্তু আমির হামজার ছেলে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘স্বাধীনতা পদকের জন্য তো একটা নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করা লাগে। আমরা সেটা করেছিলাম। এরপর যেকোনো স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তি অথবা সরকারের যেকোনো সচিবের সেই আবেদনের পক্ষে সুপারিশ লাগে। আমার বাবা আমির হামজার জন্য সুপারিশ করেছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ স্যার।’
বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমির হামজার নাম আমি প্রস্তাব করেছিলাম। তিনি একজন প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা, পালাগান করতেন এবং পরবর্তী সময়ে সাহিত্য রচনাও করেছেন। তাঁর ছেলে আমাদের সহকর্মী। খুলনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান। তাঁর কাছ থেকে তাঁর বাবার সম্পর্কে ধারণা পাই। আমি প্রস্তাব করেছি ঠিক, কমিটি নিশ্চয়ই যাচাই-বাছাই করে তাঁকে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার জন্য বিবেচনা করেছে।
আমির হামজার সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত কোনো আলাপ-পরিচয় ছিল কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যসচিব বলেন, ‘তা ছিল না।’
যাঁরা তাঁকে পুরস্কার দিয়েছেন, নিশ্চয়ই ভালোবেসেই দিয়েছেন। তবে আমি তাঁর কোনো বই পড়িনি বা নামও শুনিনি।সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
তবে স্বাধীনতা পদকের মতো রাষ্ট্রীয় মর্যাদাবান একটি সম্মাননা একজন অচেনা সাহিত্যিক পাওয়ায় ক্ষুব্ধ সাহিত্যিকমহলও। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের কাছে আমির হামজা বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি ছুড়ে দেন উল্টো প্রশ্ন, ‘উনি কে? আমি তো তাঁকে চিনি না।’ আমির হামজা সম্পর্কে সেলিনা হোসেন যে উত্তর দিয়েছেন, এই একই রকম উত্তর সাহিত্যসমাজের সবারই। তাঁদের প্রশ্ন, কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় এ পুরস্কার দেওয়া হয়?
আমির হামজা সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক নয়। যাঁরা তাঁকে পুরস্কার দিয়েছেন, নিশ্চয়ই ভালোবেসেই দিয়েছেন। তবে আমি তাঁর কোনো বই পড়িনি বা নামও শুনিনি। এ আমার অপূর্ণতা। আমি চেষ্টা করব, তাঁর বই সংগ্রহ করার।’
আমির হামজা সম্পর্কে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহাম্মদ নূরুল হুদার কাছে জানতে চাইলে তিনি এই নামে কোনো সাহিত্যিকের নাম শোনেননি বলে জানান। এই নামের ব্যক্তিকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে জানানো হলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এরই মধ্যে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
এ পুরস্কারের জন্য ব্যক্তি নির্বাচন করেন প্রধানত আমলারা। এখানে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা নির্বাচক হিসেবে না থাকায় এমন ধরনের কাণ্ড ঘটে।মুনতাসীর মামুন
এ বিষয়ে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘সাহিত্যে আমির হামজা সম্মাননা পেয়েছেন শুনে প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, সপ্তদশ শতকের কবি আমির হামজাকে পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে। যেহেতু সম্মাননাটি পেয়েছেন একজন মরণোত্তর ব্যক্তি। পরে দেখলাম, এ অন্য এক আমির হামজা, যিনি সাহিত্যিকমহলে পরিচিত নন এবং তাঁর কাজ সম্পর্কেও কেউ কিছু জানেন না।’ এ সময় তিনি স্বাধীনতা পদকের নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এ পুরস্কারের জন্য ব্যক্তি নির্বাচন করেন প্রধানত আমলারা। এখানে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা নির্বাচক হিসেবে না থাকায় এমন ধরনের কাণ্ড ঘটে।’ তিনি স্বাধীনতা পুরস্কারের নির্বাচনপ্রক্রিয়া বদলানোর দাবি করে বলেন, ‘রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার নিয়ে এমন হেলাফেলা প্রকারান্তরে সরকারেরই অপমান। তাই এই নির্বাচনপ্রক্রিয়া বদলানো উচিত বলে আমি মনে করি।’
এর আগে ২০২০ সালে এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদ নামের এক ব্যক্তিকে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য নাম ঘোষণা করা হয়। সাহিত্য অঙ্গনে একেবারে অপরিচিত ওই ব্যক্তির পুরস্কার অবশ্য পরে দেওয়া হয়নি। সেবার রইজ উদ্দিনের নাম এসেছিল ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে।
এ বছর পুরস্কারপ্রাপ্তরা হচ্ছেন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী, শহীদ কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা (বীর বিক্রম), আব্দুল জলিল, সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, প্রয়াত মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন বিশ্বাস এবং প্রয়াত সিরাজুল হক।
চিকিৎসাবিদ্যায় পুরস্কার পাচ্ছেন অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া ও অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল ইসলাম।
সাহিত্যে পুরস্কার পাচ্ছেন প্রয়াত মো. আমির হামজা এবং স্থাপত্যে প্রয়াত স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন।
গবেষণা ও প্রশিক্ষণে পুরস্কার পাচ্ছে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিডব্লিউএমআরআই)।
পুরস্কারজয়ী প্রত্যেকে পাবেন ১৮ ক্যারেট মানের ৫০ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণপদক, ৫ লাখ টাকার চেক ও একটি সম্মাননাপত্র।
জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতিবছর স্বাধীনতা পুরস্কার দিচ্ছে সরকার।