সাবলেট জ্বালা থেকে মুক্তি ছোট পরিবারবান্ধব ফ্ল্যাটে

দুই রুম ও ডাইনিং স্পেসসম্পন্ন এমন ফ্ল্যাটেই সচরাচর স্বল্প আয়ের মানুষ সাবলেট থাকেন। মীরবাগ, মগবাজার, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো
দুই রুম ও ডাইনিং স্পেসসম্পন্ন এমন ফ্ল্যাটেই সচরাচর স্বল্প আয়ের মানুষ সাবলেট থাকেন। মীরবাগ, মগবাজার, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো

ছোট পরিবার ও স্বল্প আয়ে নতুন জীবনের শুরুর বিপত্তি বাসা ভাড়ায়। উপায় না পেয়ে মানুষ সাবলেট থাকা শুরু করেন। কিন্তু ঝক্কি এতই যে মনে হবে এখনই বাসা থেকে বেরিয়ে যাই। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের প্রতি নিজের সান্ত্বনা, আর কটা দিন পরই হয়তো...। কিন্তু আয় বাড়লেও যাপিত জীবনের ব্যয়ের লাগাম ধারতে না পারায় নানা ঝামেলা সত্ত্বেও জীবনের অনেকটা সময় থাকতে হয় সাবলেটে। ছোট পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত ফ্ল্যাট না থাকায় নানান বিপত্তির মাঝেও সাবলেট থাকেন স্বল্প আয়ের মানুষ।

সালমা আক্তার ও জান্নাতুল ফেরদৌস দুজনেই গৃহিণী। সালমা স্বামীসহ রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রী এলাকায় চারতলার একটি ফ্ল্যাটে সাবলেট থাকেন। আর জান্নাতুল স্বামীসহ সাবলেট থাকেন মীরবাগ এলাকায়। দুজনের স্বামী পরস্পরের বন্ধু। ফলে দুই গৃহিণীর দেখা হলেই শুরু হয় সাবলেট থাকার অভিজ্ঞতাবিনিময়। অভিজ্ঞতা সুখকর নয় তিক্ততায় ভরা।

দুই গৃহিণীর অভিজ্ঞতার বর্ণনা থেকে জানা যায়, সমস্যাটা হয় রান্নাঘর নিয়ে বেশি। রান্নাঘরে সাবলেটদাতা পরিবারের হাঁড়ি, পাতিল, থালা-বাসনসহ অন্যান্য জিনিসপত্রে ভরা। আর তাঁদের জিনিসপত্র রান্নাঘরে রাখতে দেওয়া হয় না। রাখতে চাইলে বাধে দ্বন্দ্ব। অথচ রান্নাঘর সমান ভাগাভাগির কথা ছিল। ডাইনিং স্পেস নিয়েও সমস্যা কম নয়। বাসায় ওঠার সময় বলা হয়েছিল, ডাইনিংয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা যাবে। অতিথি এলে ডাইনিংয়ে থাকা যাবে। কিন্তু সাবলেটদাতা কর্তৃত্ব খাটিয়ে এসব শর্ত মানেন না। এসব জটিলতার কারণে কোনো কোনো বাড়িওয়ালা মূল ভাড়াটেকে সাবলেট ওঠাতে দেন না।

মহানগরীর আবাসিক এলাকা। মগবাজার, ঢাকা। ছবি: তৌহিদুল ইসলাম

ঢাকার পশ্চিম তেজতুরী বাজার এলাকায় চারতলা বাড়ির মালিক নাসরীন হোসেন বলেন, ‘সাবলেটে পারিবারিক বন্ধন ও নিরাপত্তা নষ্ট হয়। তাই আমার বাসায় সাবলেট তুলি না।’ তিনি মনে করেন, সাবলেটে থাকার চেয়ে ছোট স্বতন্ত্র ফ্ল্যাটে অথবা এক রুম ও একটি ডাইনিং স্পেস নিয়ে নবদম্পতি বা ছোট পরিবার থাকতে পারে। অবশ্য এ ধরনের ফ্ল্যাট ঢাকাতে খুবই কম বলেও জানান তিনি।

মধুবাগ এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের দোতলায় প্রশাধন কক্ষসহ এক কক্ষ সাবলেট নেন জালাল উদ্দিন। দুই কক্ষের ফ্ল্যাটের সাবলেট হিসেবে এক কক্ষের ভাড়া দেন সব মিলিয়ে ৭ হাজার টাকা। কয়েক মাস থাকার পর তিনি জানতে পারেন তাঁদের ফ্ল্যাটের ভাড়া সব মিলিয়ে ১২ হাজার টাকা। এর মধ্যে তিনিই দিচ্ছেন ৭ হাজার টাকা, বাকি ৫ হাজার টাকা যুক্ত করে বাড়ির মালিকের বাসা ভাড়া মিটিয়ে দিচ্ছেন পাঁচ সদস্যের পরিবারবিশিষ্ট সাবলেটদাতা। অবশ্য বাসায় ওঠার আগে জালালকে বলা হয়েছিল, তাঁদের ফ্ল্যাট ভাড়া ১৫ হাজার, তাঁকে দিতে হবে ৭ হাজার টাকা, বাকি ৮ হাজার দেবেন তাঁরা। জালালের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে সাবলেট বাণিজ্য করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাবলেটের বাসিন্দা বলেন, ‘যাঁরা সাবলেট দিচ্ছেন, তাঁরা নিজেরাই যেন বাসার মালিক বনে যাচ্ছেন। রান্নাঘর ও ডাইনিং স্পেস পুরোটাই তাঁরা ব্যবহার করেন। কোনোমতে রান্না শেষ করে সব জিনিসপত্র থাকার ঘরে নিয়ে যেতে হয়। সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো, ফ্ল্যাট ভাড়ার ৬০-৭০ শতাংশ সাবলেট বসবাসকারীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়, আর বাকি টাকা নিজেরা দিয়ে বাড়ির মালিককে বাসা ভাড়া দেওয়া হয়। সাবলেটে যাঁরা থাকেন, তাঁরা নানান মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যাপ্ত না থাকায় দিনের পর দিন মানসিক নির্যাতন সহ্য করে যেতে হয় তাঁদের।’

এসব ভবন থেকে দেখা যায় হাতিরঝিলের সৌন্দর্য। হাতিরঝিল, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার আবাসন কোম্পানিগুলোর নির্মিত ফ্ল্যাটগুলো অধিকাংশই তিন কক্ষের। আর ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনের বেশির ভাগ ফ্ল্যাটগুলো দুই কক্ষের। দুটি বেড রুম, দুটি বাথরুম ও একটি ডাইনিং স্পেস। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস, পানি, অন্যান্য খরচসহ সাধারণত এমন একটি ফ্ল্যাট ভাড়া পড়ে যায় অন্তত ১৬ হাজার টাকা। এলাকা ভেদে কোথাও কোথাও তা ২২ থেকে ২৪ হাজার টাকা পড়ে। অবশ্য স্থান ও ফ্ল্যাটের মান ভেদে ভাড়া কম–বেশি হয়।

এখন কথা হচ্ছে এত ব্যয়ে বাসা ভাড়া দিয়ে একজন চাকরিজীবীকে কত টাকা আয় করতে হবে? সুতরাং যাঁদের মাসিক গড় আয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা, তাঁরা সাধারণত বাধ্য হয়ে সাবলেট থাকেন। আর যাঁদের মাসিক বেতন বা আয় ১৫ হাজারের নিচে, তাঁদের বসবাস করতে দেখা যায় টিনশেড ঘর কিংবা টিনের তৈরি ঝুপড়িঘরে, সংসার না থাকলে মেসে।

সাবলেটে বসবাসকারী ও বেসরকারি চাকরিজীবী মোস্তফা কামাল বলেন, ‘এ শহরে ছোট পরিবারবান্ধব ফ্ল্যাট নেই বললেই চলে। তাই আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য সাবলেটে থাকার জ্বালা ভোগ করতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘নবদম্পতি, তিন সদস্যবিশিষ্ট পরিবার বা ছোট পরিবারের জন্য নগরে এক রুম ও ডাইনিং স্পেসসম্পন্ন স্বতন্ত্র ফ্ল্যাট বানানো দরকার। এতে অনেক পরিবার সাবলেটের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে।’

স্বামীর চাকরিসূত্রে কাঁঠালবাগান এলাকায় সাবলেট থাকেন রোকেয়া বেগম ও তাঁর স্বামী। এক রুমের জন্য তাঁদের সব মিলিয়ে ভাড়া দিতে হয় ৯ হাজার টাকা। রান্নাঘর ও ডাইনিংয়ে কোনো জিনিসপত্র রাখতে দেওয়া হয় না। তবে সাবলেটদাতা কাজের মেয়ে দিয়ে ডাইনিং পরিষ্কার করান বলে তার পারিশ্রমিকের অর্ধেক টাকা দাবি করা হয়। এ নিয়ে উভয় পরিবারের মধ্যে প্রায়ই হয় মন–কষাকষি।

বাসার পাশের সড়কে শিশুর ক্রিকেট অনুশীলন। মধুবাগ, মগবাজার, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো

তবে ইট–কাঠ–পাথরের তিলোত্তমা এই নগরীতে মিলেমিশে সাবলেট থাকার চিত্র যে নেই, তা কিন্তু নয়। সংখ্যায় অতিনগণ্য।

ব্যবসায়ী ও সাবলেটদাতা মো. মোল্লা বলেন, দুই রুমের ফ্ল্যাটের মধ্যে তিনি বন্ধুকে এক রুম সাবলেট দিয়েছেন। তাঁদের ফ্ল্যাটে দুই পরিবারের চার শিশুসহ মোট ৯ সদস্যের বসবাস। সবাই মিলেমিশে বেশ ভালোই আছেন। সব মিলে বাসাভাড়া পড়ে ১৬ হাজার টাকা। ভাড়া ৮ হাজার করে ভাগ করেন তাঁরা।

ছোট পরিবারনির্ভর পর্যাপ্ত ফ্ল্যাট না থাকায় এই মহানগরবাসীর বড় একটি অংশ সাবলেট থাকে। তাদের দাবি, আবাসন কোম্পানি ও বাড়ির মালিকেরা সুবিধামতো ভবন নির্মাণ করেন। ফলে স্বল্প আয়ের মানুষদের ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকা বা ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রতিটি ভবনে একটি বা দুটি ইউনিট ছোট পরিবারবান্ধব ফ্ল্যাট নির্মাণ করা দরকার। তাহলে অনেক পরিবার সাবলেটের জ্বালা এড়াতে পারবে। কারও কারও পক্ষে সম্ভব হতে পারে ফ্ল্যাট কেনা।

হাতিরঝিলসংলগ্ন আবাসিক এলাকা। মগবাজার, ঢাকা। ছবি: তৌহিদুল ইসলাম

এ বিষয়ে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, দেশে ১২ শতাধিক আবাসন কোম্পানি আছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ইদানীং ছোট পরিবারবান্ধব ফ্ল্যাট তৈরি করছে। কিন্তু সেসব ফ্ল্যাট সেভাবে বিক্রি হচ্ছে না। সাধারণত স্বল্প ও মধ্য আয়ের লোকদের জন্য পর্যাপ্ত ঋণ–সুবিধা না থাকার কারণে তাঁরা ফ্ল্যাট কিনতে পারছেন না।