স্বাস্থ্য খাতের অগ্রযাত্রার ৫০ : পর্ব— ৪৮

সরকারি হাসপাতালও হতে পারে আদর্শ

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালটিকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে এর ব্যবস্থাপনা।

হাসপাতালটির বিরুদ্ধে একটিমাত্র অভিযোগ, তা হলো শয্যার অতিরিক্ত একজনও বাড়তি রোগী ভর্তি করা হয় না, মেঝেতে রেখে রোগীর চিকিৎসা দেয় না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এই অনড় সিদ্ধান্তের ব্যাপারে পক্ষে-বিপক্ষে মত আছে। তবে দেশের হাসপাতালগুলোর খোঁজখবর যাঁরা রাখেন তাঁরা মনে করেন সরকারি হাসপাতালটি এখন দেশের সেরা হাসপাতাল। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এ প্রতিষ্ঠানটির নাম ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল।

হাসপাতালটির বয়স বেশি না। ২০১২ সালে যাত্রা শুরু। এই অল্প সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রায় সব ধরনের সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে হাসপাতালটি মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। গত ৫০ বছরে দেশের হাসপাতালগুলো মানসম্পন্ন সেবা ও মানুষের সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে যা করতে পারেনি ১০ বছরে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল তা করতে পেরেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট চিকিৎসকেরা মনে করেন, দেশের ভবিষ্যৎ চিকিৎসাসেবার মডেল বা আদর্শ হতে পারে হাসপাতালটি।

হাসপাতালে দালালের উৎপাত নেই। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের অবাধ চলাচল নেই। বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সচালকদের রোগী নিয়ে টানাটানির দৃশ্য নেই। হাসপাতালের করিডর, বারান্দা, ওয়ার্ড, টয়লেট পরিষ্কার। টিকিট কাটা, টাকা জমা দেওয়া, জরুরি বিভাগ বা বহির্বিভাগে রোগী দেখানো, লিফটে ওঠা-নামা—প্রায় সব জায়গায় শৃঙ্খলা চোখে পড়ে। অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে শুধু একটি মিল দেখা যায়, তা হলো রোগীর ভিড়।

স্নায়ুরোগ চিকিৎসার এটি দেশের প্রধান বিশেষায়িত হাসপাতাল। উপজেলা, জেলা ও রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল এবং চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বার থেকে স্নায়ুরোগের জরুরি ও জটিল রোগী এখানে পাঠানো হয়। এখানে আছে স্ট্রোক ইউনিট, ইপিলেপসি ক্লিনিক, ডে ক্লিনিক, মুভমেন্ট ডিজঅর্ডার ক্লিনিক। হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ৪৫০। শুরুর দিকে বহির্বিভাগে দৈনিক ২০০ থেকে ৩০০ রোগী আসত। এখন আসে দৈনিক ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার রোগী। এর মধ্যে ভর্তিযোগ্য রোগী থাকে প্রায় ২০০। দৈনিক রোগী ভর্তি করা হয় ৫০ থেকে ৬০ জন।

সেবার চাহিদার কথা বিবেচনা করে হাসপাতাল বড় করা হচ্ছে। নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে। ৫০০ শয্যা বাড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ-সুবিধাও বাড়ানো হবে।

যেসব কারণে পার্থক্য

এই হাসপাতালের পরিকল্পনা, প্রতিষ্ঠা ও এর পরিচালনার সঙ্গে শুরু থেকে যুক্ত আছেন দেশের শীর্ষ স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কাজী দীন মোহাম্মদ। তিনি একসময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। কাজী দীন মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের অন্যান্য হাসপাতালের কাঠামো ও পরিচালনার অভিজ্ঞতা এই প্রতিষ্ঠানে কাজে লাগানো হয়েছে। রোগীর মানসম্পন্ন সেবা এবং প্রশাসন পরিচালনার সুবিধার কথা মাথায় রেখে হাসপাতালের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, কোনো ওয়ার্ডে আটটির বেশি শয্যা নেই।

সরকারি হাসপাতালে পরিচালক থাকেন সাধারণত একজন। সেই পরিচালক অসুস্থ থাকলে বা অন্য কোনো কারণে অনুপস্থিত থাকলে প্রতিষ্ঠানের অনেক কাজ আটকে যায়, পিছিয়ে যায়। তাই এই প্রতিষ্ঠানে যুগ্ম পরিচালকের পদ আছে। পরিচালকের অনুপস্থিতিতে তিনি সব সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। পরিচালক বা যুগ্ম পরিচালকের একই সঙ্গে ছুটি নেওয়া বা অনুপস্থিত থাকার কোনো বিধান নেই।

হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং শৃঙ্খলা রক্ষা কর্মীর প্রায় সবাই আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োজিত। তাঁদের প্রত্যেকের কাজ সার্বক্ষণিকভাবে তদারকি ও নজরদারির কড়া ব্যবস্থা আছে। তদারকি ও নজরদারির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের জবাবদিহি করতে হয়। কাজ না করলে, কাজে ফাঁকি দিলে বেতন হয় না। এমনকি কাজ চলে যায়। এই ব্যবস্থাই হাসপাতালকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুশৃঙ্খল রাখতে সহায়তা করেছে।

আমরা এমন কিছু গবেষণাকাজে হাত দিয়েছি, যে ধরনের গবেষণা এর আগে পৃথিবীর কোথাও কোনো প্রতিষ্ঠানে হয়নি।
অধ্যাপক কাজী দীন মোহাম্মদ, পরিচালক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল

সেবাদান ব্যবস্থায় ভিন্নতা

শয্যা খালি থাকুক বা না থাকুক সরকারি হাসপাতালে রোগী এলেই ভর্তি করতে হবে, এই প্রথা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে অচল। একজনকে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিলে হাজারজনকে তা দিতে হবে। এতে প্রকৃত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব না বলে মনে করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

তবে বেশিসংখ্যক মানুষকে মানসম্পন্ন সেবা দেওয়ার জন্য জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগকে শক্তিশালী করেছে এই প্রতিষ্ঠান। এমডি বা এমএস ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরাই এসব বিভাগের দায়িত্বে। চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি ভর্তির ব্যাপারে তাঁরা মূল্যায়ন করেন। ভর্তিযোগ্য রোগীকে শয্যা খালি থাকলে ভর্তি করান। শয্যা খালি না থাকলে ভর্তিযোগ্য রোগীকে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দেন।

হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদেরও পালা অনুযায়ী বহির্বিভাগে রোগী দেখতে হয়। প্রতিদিন সকালে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকেরা প্রতিটি ওয়ার্ডে যান রোগী দেখতে, সঙ্গে থাকেন তুলনায় নবীন চিকিৎসক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। বেলা দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে চিকিৎসক আবার ওয়ার্ড ঘুরে দেখেন। নতুন ভর্তি রোগীকে রাতে দেখে যান সংশ্লিষ্ট ইউনিটের দায়িত্ব থাকা অধ্যাপক। হাসপাতালের পরিচালক বা যুগ্ম পরিচালক দিনে ও রাতে একবার করে হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।

চিকিৎসকদের দায়িত্ব পালনের এই শৃঙ্খলার সঙ্গে সংগতি রেখে নার্স, ওয়ার্ড বয়, আয়া বা অন্য সেবাকর্মীদেরও কাজ করতে হয়। সপ্তাহে সাত দিনের ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালে চিকিৎসক থেকে ওয়ার্ডমাস্টার উপস্থিত থাকেন। প্রত্যেকের কাজ তদারকি ও নজরদারি করা হয়।

শিক্ষা ও গবেষণা

প্রতিষ্ঠানের বয়স কম হলেও নিউরোলজি ও নিউরোসার্জারির উচ্চতর ডিগ্রি নিতে ইচ্ছুক এমন চিকিৎসকদের পছন্দের প্রতিষ্ঠান এখন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এমডি-এমএস কোর্সের শিক্ষার্থীরা এখানে প্রশিক্ষণ নেন।

প্রতিষ্ঠানের আছে নিজস্ব জার্নাল। প্রতি তিন মাস অন্তর নিয়মিত তা প্রকাশিত হয়। নিজেদের গবেষণার পাশাপাশি অন্য প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ এতে ছাপা হয়।

এই প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু গবেষণায় হাত দিয়েছে। এসব গবেষণা করার জন্য তারা যুক্তরাজ্যের সেফিল্ড ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেছে। একই ধরনের চুক্তি তারা করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক কাজী দীন মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এমন কিছু গবেষণাকাজে হাত দিয়েছি, যে ধরনের গবেষণা এর আগে পৃথিবীর কোথাও কোনো প্রতিষ্ঠানে হয়নি।’