আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক ও শ্রমিক লীগের ১২ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ ভূমি মন্ত্রণালয়ের।
রাজধানীর মিরপুরে ভাষানটেক পুনর্বাসন প্রকল্পের (বিআরপি) প্রাচীর ভেঙে প্রায় ৫ বিঘা জমি দখল করেছেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১২ নেতা-কর্মী। দখলের পর সেখানে ১১৭টি টিনশেড দোকান বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন তাঁরা। আকার অনুযায়ী একেকটি দোকান থেকে দুই লাখ থেকে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত অগ্রিম নেওয়া হয়েছে।
গত ৪ এপ্রিল থেকে এসব দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় বিআরপির পক্ষ থেকে ভাষানটেক থানা ও ভূমি মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পুনর্বাসন প্রকল্পটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন। ১৯৯৮ সালে প্রকল্প এলাকায় নিম্নবিত্তদের জন্য প্রায় ৪৮ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই প্রকল্পে নির্মিত হওয়া ১৮টি বহুতল ভবনে এখন ১ হাজার ৯৪৫টি পরিবার বাস করছে।
লিখে দেন এসব আমার দোকান। শেখ হাসিনার সরকার আমাদের কিছু দেয়নি, তাই আমরা দোকান বানাইছি।মোস্তাফিজুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক, ৯৫ নম্বর ওয়ার্ড, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগ
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বিআরপির পূর্ব-দক্ষিণে প্রধান সড়কের পাশ ঘেঁষে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (এফডিসি) প্রস্তাবিত জায়গার আগপর্যন্ত সীমানাপ্রাচীর ভেঙে জমিগুলো দখল করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত ভাষানটেক থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আলমগীর হোসেন ওরফে আলু আলমগীর, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহসভাপতি রকিবুল ইসলাম, ভাষানটেক থানা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান, তাঁর মেয়ে ও ৯৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের নেত্রী হ্যাপি আক্তার। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তরের ৯৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মনির হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, ৯৫ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ফরহাদ সিকদার, ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের সভাপতি মানিক মিয়া, কৃষক লীগের যুগ্ম সম্পাদক আজহারুল ইসলাম, বিআরপি ইউনিট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিমউদ্দিন ও সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হোসেন দখলের সঙ্গে জড়িত।
গত ৬ এপ্রিল বিআরপির হিসাবরক্ষক তপিন হাসান ভাষানটেক থানা ও ভূমি মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তপিন হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ভাষানটেক থানায় অভিযোগ দেওয়ার পর ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে সেটিকে নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজু করে আসামিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে থানাকে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু থানা এখনো মামলা গ্রহণ করেনি।
গতকাল এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ভাষানটেক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেলোয়ার হোসেন বলেন, জমি দখলের বিষয়টি ডিএমপি কমিশনারকে জানানো হয়েছে। তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
সম্প্রতি সরেজমিনে গেলে বিআরপির ৩ নম্বর ফটকের দক্ষিণ–পূর্ব দিকের দোকানিরা জানান, একটি দোকানের মাসিক ভাড়া ১১ থেকে ২০ হাজার টাকা। একেকটি দোকানের জন্য অগ্রিম দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে।
একটি দোকানে আসবাব তৈরি করছিলেন মো. কাজল। তিনি বলেন, তিনি আগে ফুটপাতে দোকান চালাতেন। এই মার্কেট গড়ে ওঠার পর তাঁর দোকানটি মাসে ১১ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছেন। এ জন্য তাঁকে অগ্রিম দিতে হয়েছে দুই লাখ টাকা।
একই এলাকায় কথা হয় ৯৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘লিখে দেন এসব আমার দোকান। শেখ হাসিনার সরকার আমাদের কিছু দেয়নি, তাই আমরা দোকান বানাইছি।’ সরকারি জমিতে মার্কেট করা নিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার চাইলে আবার ফেরত দিমু।’ এ সময় মোস্তাফিজুর রহমানের পাশেই ছিলেন ভাষানটেক থানা কৃষক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘মোস্তফার (মোস্তাফিজুর) বক্তব্যই আমার বক্তব্য।’
তবে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহসভাপতি রকিবুল ইসলাম সরকারি জমিতে মার্কেট নির্মাণে তাঁর জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। আর ভাষানটেক থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।’
বিআরপি বি–টাইপ ফ্ল্যাট মালিক কল্যাণ সমিতির নেতা মিনহাজুল আবেদীন বলেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা কেটে ফেলা গাছগুলো ১০-১২ লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। দখলদারেরা প্রায় ৪৭টি দোকান থেকে ৫–৬ লাখ করে মোট আড়াই কোটি টাকা অগ্রিম নিয়েছেন।
বিআরপি বি–টাইপ ফ্ল্যাট মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি হাজি কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে ভাষানটেক থানায় আবেদন করেছেন এবং পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনারকে জানিয়েছেন। এখন অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এমনটাই প্রত্যাশা করেন তিনি।