অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, হকারদের দৌরাত্ম্য, কুলিদের হয়রানিসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় পদে পদে ভোগান্তি—চিরচেনা এই রূপ ছিল দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম নদীবন্দরের (সদরঘাট)। টার্মিনাল ভবনের ভেতরে এমন ভোগান্তি ছাড়াও সদরঘাটের প্রবেশপথগুলোতে বিশৃঙ্খলা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে স্বাভাবিক হাঁটাচলারও উপায় ছিল না। সম্প্রতি সদরঘাটের এই চিত্র বদলেছে।
ঢাকা নদীবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য তারা দেড় বছর ধরে প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এখন যাত্রীরা এর সুফল পাচ্ছেন। এ অবস্থা ধরে রাখতে, ৩২টি ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা দিয়ে সব সময় নজরদারি করা হচ্ছে। যাত্রীরাও বর্তমান ব্যবস্থাপনায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
সরেজমিনে দেখা গেল, মূল টার্মিনালের পন্টুনে কোথাও হকার নেই। যাত্রীদের জিনিসপত্র বহন নিয়ে কুলিদের মধ্যেও টানাহেঁচড়া নেই। অনেকটা সুনসানই বলা চলে। নির্ধারিত গন্তব্যে রওনা করার আগে কোনো হয়রানি ছাড়াই যাত্রীরা লঞ্চে উঠে যাচ্ছেন। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা যাত্রীরা অনেকটা নির্বিঘ্নেই লঞ্চ থেকে নেমে যে যাঁর গন্তব্যে যাচ্ছেন।
পটুয়াখালী থেকে আসা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, প্রায় এক বছর পর ঢাকায় এসেছেন। সদরঘাটের পরিচ্ছন্নতা ও পন্টুনে হকার না দেখে বেশ অবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, অবস্থার পরিবর্তন হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরে আর তদারকি থাকে না। বন্দর কর্তৃপক্ষকে এই পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
সদরঘাট টার্মিনালের মূল ভবন থেকে পন্টুন পর্যন্ত খালি জায়গায় একসময় ডিঙিনৌকা, ভাসমান দোকান ও বর্জ্যে ছিল ঠাসা। এ অংশ পরিচ্ছন্ন করে ভাসমান দোকান ও ডিঙিনৌকা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূল টার্মিনালে ঢুকে দেখা গেল, ভবঘুরেদের আনাগোনা নেই। সিসি ক্যামেরায় এমন কাউকে দেখা গেলে তখনই তাকে বের করে দেওয়া হচ্ছে।
পুরোনো টার্মিনাল ভবন (টার্মিনাল ভবন-১) ও নতুন টার্মিনাল ভবনের (টার্মিনাল ভবন-২) নিচতলায় তিনটি শৌচাগার বেশ পরিচ্ছন্ন। নিচতলায় শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর কক্ষ ও মেডিকেল সেন্টার করা হয়েছে। তবে মেডিকেল সেন্টারটি বন্ধ রয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, ঈদের সময় মেডিকেল সেন্টারগুলো ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। বাকি সময়ে তাৎক্ষণিকভাবে যাত্রীদের চিকিৎসাসেবার প্রয়োজন হলে ব্যবস্থা করা হয়।
পুরোনো টার্মিনাল ভবনের ভেতরে বেশ কয়েকটি দোকান ছিল। টার্মিনালের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য এসব দোকান ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ভেঙে ফেলা ওই দোকানগুলোর সামনে নদীতীরে হরেক রকমের ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে। এর কয়েকটিতে ফুলও ফুটেছে। টার্মিনাল ভবনের দক্ষিণ দিকে সড়কের পাশে বাগানবিলাসসহ নানা প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে।
>ঢাকা নদীবন্দরে এখন হকারদের দৌরাত্ম্য নেই, পরিবেশ অনেকটাই পরিচ্ছন্ন
যাত্রীরাও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
নতুন টার্মিনাল ভবনের পশ্চিম দিকে খালি জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছিল মোবাইল মার্কেট। ওই মার্কেট উচ্ছেদ করে সেখানে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, পার্কিং এলাকায়ও কোনো হকার নেই। অনেকটাই নিরিবিলি পরিবেশ। এ ছাড়া টার্মিনাল ভবনের পশ্চিম দিকে আহসান মঞ্জিল পর্যন্ত এবং পূর্ব দিকে শ্যামবাজার মসজিদ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীতীরে হরেক রকমের গাছ লাগানো হয়েছে।
বুড়িগঙ্গা নদী থেকে একসময় আহসান মঞ্জিলের সৌন্দর্য চোখে পড়ত না। সম্প্রতি এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যের সামনের সড়কে থাকা ফুটপাত অবমুক্ত এবং অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করায় বুড়িগঙ্গা থেকে এর সৌন্দর্য উপভোগ করা যাচ্ছে। তবে আহসান মঞ্জিলের পর থেকে বাদামতলী পর্যন্ত মূল সড়কে পার্কিং করে রাখা মালবাহী ট্রাকগুলো সরানো সম্ভব হয়নি।
সদরঘাট থেকে ফেরার পথে জনসন রোডে এসে দেখা গেল, এই সড়কের দুই পাশের ফুটপাত দখলমুক্ত করা হয়েছে। যান চলাচলও নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে সদরঘাটে যাওয়া-আসার পথে এই সড়কটি বেশির ভাগ যাত্রী ব্যবহার করেন। ফুটপাত দখলমুক্ত করার কারণে এই সড়কে চিরচেনা দুর্বিষহ সেই যানজটও চোখে পড়েনি।
চার ঘণ্টা সদরঘাট পরিদর্শনে বোঝা গেল, আবর্জনায় ঠাসা সদরঘাট এখন কেবল পরিচ্ছন্নই হয়নি, সেই সঙ্গে যাত্রীদের দুর্ভোগও কমেছে। একসঙ্গে দু–তিনটি লঞ্চ এসে পৌঁছালেও বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে যাত্রীদের তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গুলিস্তানের দিকে আসার সড়কে যানজটের ভোগান্তির চিত্র এখনো বদলায়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা নদীবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা এ কে এম আরিফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাত্রী পরিবহনের দিক দিয়ে সদরঘাট দেশের সবচেয়ে বড় নদীবন্দর। এ বন্দরের অব্যবস্থাপনার কারণে লোকমুখে প্রচলিত বদনাম ছিল, “ওপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট”। আমরা এই বদনাম ঘোচাতে দেড় বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। যাত্রীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে যা যা প্রয়োজন, তা–ই করার চেষ্টা করছি।’