সগিরা মোর্শেদ সালাম হত্যা মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি পিছিয়েছে। আগামী ৭ অক্টোবর মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ঠিক করেছেন আদালত। আজ সোমবার ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ এ আদেশ দেন।
রাষ্ট্রপক্ষের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) তাপস কুমার পাল প্রথম আলোকে বলেন, এ মামলায় আসামিদের পক্ষ থেকে অভিযোগ গঠনের সময় পেছানোর জন্য আদালতের কাছে আবেদন করা হয়।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আদালতকে জানান, তাঁরা এ মামলার কিছু কাগজপত্রের নকল কপি এখনো পাননি। তাই আদালত উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে অভিযোগ গঠনের শুনানির নতুন দিন ঠিক করেছেন। গত ২১ জানুয়ারি সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলায় অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পারিবারিক তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় বলে পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে আসে। সগিরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন চারজন। তাঁরা হলেন আসামি মারুফ রেজা, আনাস মাহমুদ, আনাসের দুলাভাই চিকিৎসক হাসান আলী চৌধুরী (নিহত সগিরার ভাশুর) ও তাঁর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা। সগিরা মোর্শেদ (৩৪) বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ছিলেন।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণে জানা যায়, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই সগিরা মোর্শেদ ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তের কবলে পড়েন। একপর্যায়ে দৌড় দিলে তাঁকে গুলি করা হয়। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে সগিরা মোর্শেদ মারা যান। সেদিনই রমনা থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন তাঁর স্বামী সালাম চৌধুরী। প্রত্যক্ষদর্শী রিকশাচালক জড়িত দুজনের কথা বললেও মিন্টু ওরফে মন্টু নামের একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি মন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। নেওয়া হয় সাতজনের সাক্ষ্য। বাদীপক্ষের সাক্ষ্যে আসামি মন্টু ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানের নিকটাত্মীয় মারুফ রেজার নাম আসে। পরে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২৩ মে বিচারিক আদালত অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। এ আদেশের বিরুদ্ধে মারুফ রেজা হাইকোর্টে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২ জুলাই হাইকোর্ট রুল দিয়ে অধিকতর তদন্তের আদেশ স্থগিত করেন। পরের বছর ২৭ আগস্ট অপর এক আদেশে হাইকোর্ট ওই রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ান। এতে থমকে যায় মামলার কার্যক্রম।
বিষয়টি নজরে এলে ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের জন্য উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি নিয়ে ২০১৯ সালের ২৬ জুন হাইকোর্টের একই বেঞ্চ মামলার অধিকতর তদন্ত আদেশে ইতিপূর্বে দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেন। একই সঙ্গে ৬০ দিনের মধ্যে ওই মামলার অধিকতর তদন্ত শেষ করতে পিবিআইকে নির্দেশ দেন।
আদালতকে জমা দেওয়া পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সগিরা মোর্শেদের স্বামীর নাম আবদুস সালাম চৌধুরী। তাঁর (সালাম চৌধুরী) বড় ভাইয়ের নাম সামছুল আলম চৌধুরী। মেজ ভাই চিকিৎসক হাসান আলী চৌধুরী। তিনজনই তাঁদের পরিবার নিয়ে আউটার সার্কুলার রোডে তখন বসবাস করতেন। সগিরা মোর্শেদেরা থাকতেন দ্বিতীয় তলায়। চিকিৎসক হাসান তাঁর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদাকে নিয়ে থাকতেন ওই বাসার তৃতীয় তলায়। সায়েদাতুল মাহমুদা তিন তলা থেকে প্রায় সময় ময়লা-আবর্জনা ফেলতেন, যা সগিরা মোর্শেদের পেছনের রান্নাঘর ও সামনের বারান্দায় পড়ত। এ নিয়ে সগিরার সঙ্গে মাহমুদার প্রায় ঝগড়াঝাঁটি হতো। আর শাশুড়ি থাকতেন সগিরার সঙ্গে। তাঁর শাশুড়ি তাঁকে ভালোবাসতেন। এ নিয়ে সায়েদাতুল মাহমুদা খুব হিংসা করতেন। ঝগড়ার সময় সগিরাকে মাহমুদা বলতেন, ‘দাঁড়া, আমার ভাই রেজওয়ান (আনাস মাহমুদ) আসুক। আমার ভাইকে দিয়ে তোকে মজা দেখাব। তোকে ঘর থেকে বের করব।’
পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পারিবারিক তুচ্ছ কারণে হাসান আলী ও তাঁর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদার মনে ইগোর জন্ম হয়। একসময় সায়েদাতুল মাহমুদা সগিরাকে শায়েস্তা করার জন্য তাঁর স্বামী হাসানকে বলেন। হাসান তাতে রাজি হন। চিকিৎসক হাসানের রোগী ছিলেন মারুফ রেজা। যিনি তৎকালীন সিদ্ধেশ্বরী এলাকার সন্ত্রাসী ছিলেন। এই মারুফ ছিলেন সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসানের আত্মীয়। সগিরাকে শায়েস্তা করার জন্য মারুফের সঙ্গে কথা বলেন চিকিৎসক হাসান। ওই কাজের জন্য মারুফকে তখন ২৫ হাজার টাকা দিতে রাজি হন হাসান। আর হাসান তখন মারুফ রেজার সহযোগী হিসেবে নিয়োগ করেন তাঁর শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ানকে, যাতে সগিরাকে সহজে দেখিয়ে দিতে পারেন। আনাস তাঁর দুলাভাই হাসানের বাসায় যাতায়াত করতেন। এ কারণে তিনি সগিরাকে চিনতেন।