চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মারা যান মাসুদ রানা (৩৪) ও মাহবুবুর রহমান (২৮) নামের দুই ভাই। ঘটনার দুই বছর পর ছেলেদের কথা মনে পড়তেই চোখে পানি এল তাঁদের বাবা সাহেব উল্লাহর। মাসুদ ও মাহবুব মুঠোফোনের উপকরণ (অ্যাকসেসরিজ) বিক্রি করতেন। ওয়াহেদ ম্যানশনে যখন আগুন লাগে, তখন ভবনটির নিচতলার দোকানেই ছিলেন তাঁরা। আগুন নেভানোর পর তাঁদের লাশ উদ্ধার করা হয়। চকবাজারে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন সাহেব উল্লাহ। তাঁর বয়স এখন ৮০ বছর। পাঁচজনের সংসার তাঁর। সাহেব উল্লাহ নিজে, তাঁর স্ত্রী, ছোট ছেলে, মারা যাওয়া মেজ ছেলের স্ত্রী ও সন্তান। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার হিসেবে সব মিলিয়ে সাত লাখ টাকার মতো অর্থসহায়তা পেলেও তা শেষ হয়ে গেছে। এখন দিন চলছে কোনোরকমে।
ওই দিনের আগুনে মুনসুর আলী হারান আপন দুই ভাই মোহাম্মদ আলী, অপু রায়হান এবং ভাতিজা ছোট্ট আরাফাতকে। কেবল দুটি পরিবারের সদস্য নয়, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ ওই আগুনে মারা যান ৭১ জন। স্বজনেরা হারানো প্রিয়জনের কথা স্মরণ করে চোখের পানি ফেলেন আর ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আশায় বুক বাঁধেন। কিন্তু ওই ভয়াবহ আগুনে মৃত্যুর দুই বছর পার হলেও পুলিশ মামলার তদন্তকাজ শেষ করতে পারেনি। আদালতে জমা পড়েনি কোনো তদন্ত প্রতিবেদন। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত (সিএমএম) পুলিশ এখন পর্যন্ত ১৬ বার সময় দিয়েছেন। কবে নাগাদ এ মামলার তদন্তকাজ শেষ হবে, তা–ও জানাতে পারছে না পুলিশ।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজন হারানো মুনসুর আলী গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাগ্যগুণে সেদিন আমি আগুন থেকে বেঁচে গিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার চোখের সামনে আগুনে পুড়ে মারা গেছে আমার আপন দুই ভাই আর ভাতিজা। এই কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে এখনো ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে দিয়ে আমি যাতায়াত করি। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বাড়িটার রং করা হয়েছে। বাড়ির দুই মালিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু পুলিশ এখনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারল না।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার পরিদর্শক কবির হোসেন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, চুড়িহাট্টার আগুনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। অল্প সময়ের ব্যবধানে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। কেন দুই বছরেও তদন্ত শেষ হয়নি, সে সম্পর্কে পুলিশ কর্মকর্তা কবির হোসেন বলেন, ‘সমস্ত কাগজপত্র সংগ্রহ করে, সবকিছু ঠিকঠাক করেই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এ মামলাতেও সঠিক ও নির্ভুল তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’
চুড়িহাট্টা মোড়ের কাছে চারতলা হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে লাগা আগুন আশপাশের কয়েকটি ভবনে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রায় ১৪ ঘণ্টা চেষ্টার পর সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।
চুড়িহাট্টার আগুনে নিহত চকবাজারের ওয়ার্কস রোডের বাসিন্দা জুম্মন আলী (৫২)। তাঁর ছেলে মো. আসিফ বাদী হয়ে ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক দুই সহোদর মো. হাসান ও মো. সোহেল ওরফে শহীদের নামে চকবাজার থানায় মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, হাসান, সোহেলসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১০ থেকে ১২ জনের ইচ্ছাকৃত অবহেলায় ঘটা আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ৭১ জন। মামলার এজাহারে বলা হয়, হাসান ও সোহেল ওয়াহেদ ম্যানশনের ওই ভবনের বিভিন্ন তলায় দাহ্য পদার্থ রাখতেন। জীবনের ঝুঁকি জেনেও অবৈধভাবে রাসায়নিকের গুদাম করার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে বাসা ভাড়া দেন তাঁরা। এই দুই আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করে পরে জামিন পেয়েছেন।
চুড়িহাট্টার আগুনের পর প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও ঘটনাস্থলের আলামত দেখে তদন্তকারী বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা তখন বলেছিলেন, আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা থেকে। তবে মামলায় দাবি করা হয়, চুড়িহাট্টার গলিতে যানজটে আটক থাকা একটি পিকআপের ওপরে থাকা এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ঠিক কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দেননি তদন্ত কর্মকর্তা কবির হোসেন। তিনি বলেন, তদন্ত শেষ না হওয়ায় এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না।
চোখের সামনে আগুনে পুড়ে মারা গেছে আমার আপন দুই ভাই আর ভাতিজা। এই কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।মুনসুর আলী, নিহত তিনজনের স্বজন
মামলার বাদী মো. আসিফ প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের কারণে (বাড়িওয়ালা) তাঁর বাবাসহ এতজন নিরীহ মানুষ মারা গেছেন, তাঁরা জামিন নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ পুলিশের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
মামলা, বিচার কোনো কিছুই বোঝে না ১৩ বছরের তারিফুর ইসলাম রামিম। তবে ওই দিনের ঘটনায় তার ছোট্ট মনে ভয় ঢুকে গেছে। সেই দিনের ঘটনায় বাবা রাশেদুল ইসলাম, মা সানিয়া ইসলাম ও ছোট ভাই তাওহিদুল ইসলামকে হারিয়েছে সে। মা-বাবা হারানোর ক্ষত আর নিজের হাতে ও মুখে আগুনের পোড়া চিহ্ন রয়ে গেছে তার।
লালবাগের বাসায় যখন তারিফুরের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন পাশে বসা তার নানি অনবরত কাঁদছিলেন। চোখে পানি ছিল না তারিফুরের, শুধু কেঁপে কেঁপে উঠছিল সে।