নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আজও সমান অধিকারের সমাজ তৈরি করা যায়নি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে ক্ষমতায়নের দিক দিয়ে নারীর অগ্রগতি হয়েছে। তবে সমাজে নারীর সমান অবস্থান নিশ্চিত হয়নি। সমান অবস্থানের পথে বাধা হয়ে আছে বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন।
আজ শনিবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আয়োজিত নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতীয় সম্মেলন ২০২১–এ এসব কথা বলেন বক্তারা।
‘নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও একসাথে’ প্রতিপাদ্য নিয়ে এই সম্মেলনের আয়োজন করে ‘আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট (উই ক্যান)’ সংক্ষেপে আমরাই পারি জোট। এতে সহযোগিতা করেছে অক্সফাম এবং কানাডা সরকারের গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা তহবিল।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, দেশের নারীরা তুলনামূলক কম শক্তিধর বলে তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাল্যবিবাহ নিয়ে বিব্রত হতে হয়। দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে যেভাবে সরকার কাজ করছে সেভাবে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। এই কাজে নাগরিক সমাজ, শিক্ষার্থী, বেসরকারি সংস্থা সবাইকে এক হতে হবে। আবেগে ভেঙে না পড়ে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হবে। এ ব্যাপারে তিনি মিরপুরে শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের পতাকা গেড়ে রাখার ঘটনাকে টেনে এনে বলেন, ‘অনেকে আজব কিসিমের কাজ করছে। এটা লজ্জার লজ্জার লজ্জার।’
সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন আমরাই পারি জোট-এর চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, নারী ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট সরকারি পেশাজীবীদের সঙ্গে আলোচনায় বসলে দেখা যায়, তাঁরা এ ব্যাপারে পূর্ব ধারণা নিয়ে রাখেন এবং নিজেদের সিদ্ধান্তকে যথাযথ মনে করেন। এ কারণে নারীর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে স্কুল পর্যায় থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। স্কুলের শিক্ষার্থীদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন তারা অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, সবাইকে গ্রহণ এবং বৈচিত্র্যকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা নিয়ে বড় হয়। তিনি বলেন,সমাজে নারীর সমান অবস্থান নিশ্চিত করতে পারিবারিক আইন পরিবর্তনের বিষয়ে সবাই এক হতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, নারীর অধিকার রক্ষায় সমাজের সব মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে এ লড়াইয়ে জয়ী হওয়া যাবে না।
সাংসদ আরমা দত্ত বলেন, নারীর অধিকার হচ্ছে মানবাধিকার। নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে দেশে অনেক ভালো ভালো আইন আছে। তবে তা যথাযথ বাস্তবায়নের জায়গায় আটকে আছে। সমাজ সংবেদনশীল না হলে পরিবর্তন আসে না। এত কিছুর পরও দেশের নারীরা এগিয়ে চলেছেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশ এখন নারী জাগরণ ও ক্ষমতায়নের মডেল।
আমরাই পারি জোট-এর কো-চেয়ার শাহীন আনাম বলেন, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকে দায়িত্ব মনে করতে হবে প্রত্যেকের। সবাইকে একসঙ্গে লড়াই করতে হবে। নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনা গেলে শুধু পুলিশ আর আইন দিয়ে কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। বাল্যবিবাহের মাধ্যমে একটি মেয়ের মানবাধিকারকে চরমভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। বাড়িতে ও সমাজে নারীর প্রতি মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে নারী নির্যাতন বন্ধ হবে না।
বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) ও জ্যেষ্ঠ জেলা জজ মো. গোলাম কিবরিয়া তাঁর বিচারকার্যের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো শুরুতে গোপন করার একধরনের প্রবণতা দেখা যায় পরিবার ও সমাজে। গোপন সমঝোতার চেষ্টা করা হয়। এটা করতে গিয়ে তারা বিচার চাইতে দেরি করে ফেলে। নির্যাতনের ঘটনার পরপর মেডিকেল পরীক্ষা করা হলে, থানায় অভিযোগ জানালে বিচারকাজ সহজ হয়। তিনি আর্থিক দৈন্যের কারণে আসামির কাছ থেকে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় করা না গেলে রাষ্ট্রকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান।
নির্যাতনের ঘটনার পরপর মেডিকেল পরীক্ষা করা হলে, থানায় অভিযোগ জানালে বিচারকাজ সহজ হয়।মো. গোলাম কিবরিয়া, জ্যেষ্ঠ জেলা জজ
অক্সফামের হেড অব জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড সোশ্যাল ইনক্লুশন মাহমুদা সুলতানা বলেন, নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতনও একধরনের মহামারি। এটা উপেক্ষিত মহামারি। অক্সফামের বৈশ্বিক গবেষণার তথ্য অনুসারে, কোভিড মহামারিতে বিশ্বজুড়ে হটলাইন নম্বরে নারীদের অভিযোগ বেড়েছে ২৫ থেকে ১১১ গুণ। তবে বাংলাদেশে নারীরা সামাজিক অবস্থানের কারণে নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাহায্য চাইতে দ্বিধা করেন। কারণ, এখানে নির্যাতনের শিকার নারীকে বিচার পাইয়ে দিতে সাহায্য না করে দোষ খোঁজা হয়।
সম্মেলনে দুটি অধিবেশনে ‘বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ: আর্থসামাজিক চালিকা শক্তি ও আইনের সীমাবদ্ধতা’ এবং ‘নারীর প্রতি সহিংসতা: আইনের প্রয়োগ, শিখন ও প্রতিবন্ধকতা’ বিষয়ে পৃথক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন আমরাই পারি জোট-এর প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক। তিনি সেমিনার থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরে বলেন, উত্তরাধিকার, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি বৈষম্যমূলক আইনে পরিবর্তন আনতে, বাল্যবিবাহ রোধে, নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে।
নারীর অধিকার বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন, নীতিমালা ও উদ্যোগকে কার্যকর করতে নারী আন্দোলনের ৯টি দাবিকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানানো হয়। সেগুলো হচ্ছে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। উচ্চ আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। বিচার চলাকালে নির্যাতনের শিকার নারী, শিশু ও পরিবারের নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলায় সাক্ষী দেওয়ার প্রক্রিয়া যুগোপযোগী করতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। পারিবারিক নির্যাতন (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ সফল করতে হবে। ধর্ষণ, যৌন সহিংসতা, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরকারকে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি নিতে হবে। নারী নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সব ধরনের বৈষম্যমূলক আইন ও নারী নির্যাতনবিরোধী আইন সংশোধন করতে হবে।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ২০০৪ সাল থেকে শুরু হয় আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের এই সামাজিক আন্দোলন। এই আন্দোলনে এখন সমাজে পরিবর্তনকারীর ভূমিকা নেওয়া বা চেঞ্জমেকারের সংখ্যা ১০ লাখ ৪৩ হাজার ৩৯৬। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৫১২ জন। নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ভূমিকা রাখায় প্রথমবারের মতো পাঁচ নারী-পুরুষকে দেওয়া হয় ‘চেঞ্জমেকার পদক ২০২১’। পদকপ্রাপ্তরা হলেন রংপুরের তানজিলা তাসনিম, রংপুরের মো. দেলোয়ার হোসেন, ঢাকার হুমায়রা বেগম, দিনাজপুরের রূপালী রানী দাস ও নোয়াখালীর পারুল আক্তার।