মে দিবস

শিশুশ্রমমুক্ত আট খাত কেবল কাগজ–কলমে

রাজধানীতে প্রশাসনের নাকের ডগায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা। করোনার প্রভাবে শিশুশ্রম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা

আবু বকরের বয়স আট বছর। সে কাজ করে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে একটি জুতার কারখানায়। কাজে আসে সকাল আটটায়, আর বাসায় ফেরে রাত নয়টায়। প্রতিদিন এভাবে কাজ করে সপ্তাহ শেষে সে বেতন পায় মাত্র চার হাজার টাকা।

মঙ্গলবার দুপুরে কামরাঙ্গীরচরের হুজুরপাড়ায় ওই জুতা কারখানায় গিয়ে আবু বকরের মতো আরও ১০ শিশুকে পাওয়া গেল, যাদের বয়স গড়ে ৯ থেকে ১২ বছর। যারা প্রতিদিন একই সময় পর্যন্ত কাজ করে।

কেবল এই কারখানাটিতেই নয়, কামরাঙ্গীরচর, চকবাজার, বংশালসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় অনেক ছোট ছোট জুতার কারখানা রয়েছে। সেসব কারখানায় দুই শর বেশি শিশুশ্রমিক কাজ করে আসছে।

এক বছর জুতার কারখানায় কাজ করা ছোট্ট শিশু আরিফুল ইসলাম জানাল, তারা চার ভাই, এক বোন। থাকে কামরাঙ্গীরচরের একটি বস্তিতে। বাবা রিকশা চালান। মাস শেষে যে টাকা বেতন পায়, বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেয়।

সব শিশুশ্রমিকের তালিকা তৈরি করা জরুরি। এরপর সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব
মুজিবুল হক, সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী

কামরাঙ্গীরচরের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর এলাকায় অনেক ছোট ছোট জুতার কারখানা রয়েছে। দরিদ্র পরিবারের অনেক শিশু এসব কারখানায় কাজ করে। জুতার কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এসব শিশুকে যুক্ত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেবল জুতার কারখানায় নয়, সাভারের হেমায়েতপুরের ট্যানারির মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও শতাধিক শিশু-কিশোর যুক্ত রয়েছে।

অথচ পাদুকাশিল্প, ট্যানারি, রেশম, সিরামিক, গ্লাস, জাহাজ প্রক্রিয়াজাতকরণ, চিংড়ি এবং রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পকে শিশুশ্রমমুক্ত ঘোষণা করেছে সরকার। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ছয়টি খাতকে শিশুশ্রমমুক্ত ঘোষণা করা হয়।

কাগজে-কলমে এসব খাতকে শিশুশ্রমমুক্ত ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে শিশুরা প্রতিনিয়ত এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছে।

সরকারি নজরদারির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের জানা ছিল না যে কামরাঙ্গীরচরসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট জুতার কারখানায় এত শিশুশ্রমিক কাজ করছে। পাদুকাশিল্পে শিশুশ্রমিক নিয়োগ পুরোপুরি অবৈধ। যেসব কারখানা এসব শিশুকে নিয়োগ দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে শিগগিরই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী, ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে কারখানায় নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই। আবার ১৪ বছর থেকে ১৮ বছর বয়সীদের সরকারঘোষিত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। তাদের কেবল হালকা কাজে যুক্ত করা যাবে।

বিড়ি-সিগারেট তৈরির কারখানাসহ ৩৮টি খাতকে শিশুদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় রয়েছে অ্যালুমিনিয়ামজাত দ্রব্যাদি তৈরি, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, ব্যাটারি রি–চার্জিং, বিড়ি ও সিগারেট তৈরি, লেদ মেশিন, কাচের সামগ্রী তৈরি, লবণ তৈরি, প্লাস্টিক সামগ্রী, সাবান তৈরি।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ২১ কোটি ২০ লাখ। বাংলাদেশে আছে ৩২ লাখ। এর মধ্যে ১৩ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি কাজ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে।

এই প্রতিবেদন বলছে, শিশুশ্রমিকদের অর্ধেকের বেশি কাজ করে কৃষি খাতে (৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ)। এ ছাড়া ২৫ দশমিক ৯ শতাংশ সেবা খাতে এবং শিল্পে কাজ করছে ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু।

২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ ঘোষণা করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। তবে এ খাতের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, শিশুশ্রমের বড় কারণ দারিদ্র্য। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা মূলত শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করে আসছে। তাই ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রমিকমুক্ত বাংলাদেশ হবে বলে তাঁরা মনে করেন না।

ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা শাবনাজ জাহেরীন বলেন, বাংলাদেশে কাজ করছে ১২ লাখের বেশি শিশুশ্রমিক। তাদের সেখান থেকে বের করে আনার জন্য যে ধরনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার, সেটা নেওয়া হয়নি।

আবার চলমান করোনা মহামারির প্রভাবে শিশুশ্রম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছে আইএলও। সংস্থাটির এক প্রতিবেদন বলছে, করোনার কারণে লাখ লাখ শিশুকে শিশুশ্রমে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা এ খাতে গত ২০ বছরের অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসি ও বিআইজিডির গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, করোনায় দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি।

নজরদারি নেই, নেই ডেটাবেইস

নোয়াখালীর সায়েমের বয়স ১৩ বছর। এক বছর ধরে সে কাজ করছে সাভারের হেমায়েতপুরের ট্যানারি কারখানায়। বুধবার বিকেলে ট্যানারি কারখানা ঘুরে দেখা গেল, অনেক শিশু-কিশোর সেখানে কাজ করছে।

১৪ বছর বয়সী দুই কিশোর মো. মামুন ও হৃদয় বলল, ছয় মাস ধরে ট্যানারিতে কাজ করছে তারা। মাসে বেতন পায় ৮ হাজার টাকা। ট্যানারি শ্রমিক নেতা আবদুর রহিমও বললেন, আগের চেয়ে ট্যানারিতে শিশু-কিশোর শ্রমিক কমেছে। তবে এখনো যথেষ্টসংখ্যক আছে। কেবল ট্যানারি নয়, ঢাকার চারপাশে গড়ে ওঠা কয়েক শ ইটভাটায় বহু শিশু কাজ করছে।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যখন শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম, তখন বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। তবে বাংলাদেশে এখনো লাখ লাখ শিশু শ্রমিক আছে। তারা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে এসব দরিদ্র পরিবারকে। আর দরকার পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেইস। সব শিশুশ্রমিকের তালিকা তৈরি করা জরুরি। এরপর সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।’

নানা রোগে আক্রান্ত শিশুরা

ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়; বিশেষ করে নিউমোনিয়া, কাশি, ফুসফুসে প্রদাহ, শ্বাসকষ্ট, ক্ষুধামান্দ্য ইত্যাদিতে ভোগে।

পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক অসীম চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, কামরাঙ্গীরচর, কেরানীগঞ্জ, চকবাজারসহ আশপাশের এলাকায় বহু ছোট কারখানা রয়েছে। জুতার কারখানাসহ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের বড় অংশ অপুষ্টিতে ভোগে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার কারণে বেশির ভাগ শিশুর ফুসফুসে প্রদাহ হয়। অনেকের চর্মরোগ হয়।