শাহজালাল বিমানবন্দর: মশার পরান বধিবে কে?

প্রিয়জনের অপেক্ষায় এক স্বজন। কিন্তু মশার অত্যাচারের কি বসার জো আছে? তাই কয়েল জ্বেলে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার
প্রিয়জনের অপেক্ষায় এক স্বজন। কিন্তু মশার অত্যাচারের কি বসার জো আছে? তাই কয়েল জ্বেলে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার

একটির প্রাণ আছে, আকারে ক্ষুদ্র। অন্যটি প্রাণহীন বিশাল বাহন। দূরদূরান্ত থেকে উড়ে উড়ে এ রকম অসংখ্য বাহন চলে আসে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। যাত্রী নামিয়ে আবার উড়াল দিয়ে চলে যায় এই বাহন। আর ‘মশা’ বিশাল এই বিমানবন্দরজুড়ে বসে আসে। উড়োজাহাজ এলেই ঝাঁকে ঝাঁকে ভেতরে মশা ঢুকে পড়ে। কখনো কখনো উড়োজাহাজের যাত্রাও বন্ধ করে দেয় এই মশা!

দেশের প্রধান এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ থেকে শুরু করে হাজারো যাত্রী—সবাই মশার কাছে আত্মসমর্পণ করে নিত্যদিন আসা-যাওয়া করছে। শুধু কি তাই, শ্রমিক, শুল্ক কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য—যাঁরা পেশার টানে শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রতিদিন আসেন, তাঁদের মশার কামড় খেতেই হয়। মশা মারতে কখনো কখনো ফগার মেশিনের তর্জন-গর্জনও চলে। কিন্তু শাহজালাল বিমানবন্দরে মশার দাপট একটুও কমে না। আর মশা মারা নিয়েও চলে রশি–টানাটানি। সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ জবাব, ‘মশা মারার দায় সিটি করপোরেশনের।’ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে উত্তর মেলে—‘অনুমতি ছাড়া বিমানবন্দরে প্রবেশ নিষেধ। অনুমতি দিয়ে ডাক দিলে তারা মশা মরতে সদা প্রস্তুত।’

হাতে হামলে পড়েছে মশা। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার

বিমানবন্দরে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে প্রতিদিন দেড় শর মতো উড়োজাহাজ ওঠানামা করে। তাই এখানে প্রতিদিন আসেন ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার যাত্রী। দিনের বেলা এলে মশার কবল থেকে কিছুটা রক্ষা পান তাঁরা। কিন্তু উড়োজাহাজ আসা-যাওয়ার সময় ভোরবেলা অথবা রাত হলে রক্ষা পাওয়ার উপায় থাকে না যাত্রীদের।

এমনই এক যাত্রী সাদাব তাবানী। ১০ ফেব্রুয়ারি সপরিবারে ভারত ভ্রমণে যান। ওই রাত নয়টায় এয়ার ইন্ডিয়ায় তাঁর ফ্লাইট ছিল। কিন্তু উড়োজাহাজ ছাড়তে দেরি হয় দুই ঘণ্টা। স্ত্রী, দেড় বছরের মেয়ে ও মাকে নিয়ে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে থাকেন সাদাব। এই দুই ঘণ্টা রীতিমতো নাভিশ্বাস অবস্থা তাঁদের সবার। অসংখ্য মশার কামড়ে মেয়েটি কান্না জুড়ে দেয়। রাত ১১টার দিকে উড়োজাহাজের আসনে বসলেও মশার কামড় থেকে নিস্তার মেলেনি। আকাশে উড়াল দিলেও মশা সরে যায়নি। বেশ কিছু মশাকে সঙ্গী করেই সাদাব তাবানী কলকাতা পৌঁছান।

একটু সুযোগ পেলে এভাবেই অপেক্ষমাণ ব্যক্তিদের শরীরে হামলে পড়ে মশার ঝাঁক। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার

মশার হাত থেকে রক্ষার আকুতি জানিয়ে গত ২৯ জানুয়ারি বিমান ক্যাজুয়াল শ্রমিক লীগের পক্ষ থেকে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে খোলা চিঠি লেখা হয়। চিঠির বিষয় ছিল: মশার উপদ্রব হতে বাঁচার আকুতি।

১৯৭১ একর আয়তনের শাহজালাল বিমানবন্দরের প্রায় অর্ধেক জায়গাজুড়ে আছে ছোট-বড় জলাশয় । প্রতিবছর মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাস বৃষ্টির কারণে এই জলাশয়গুলো পানিতে ভরে যায়। বর্ষা চলে যাওয়ার পর শুষ্ক মৌসুমে এসব জলাশয়ে অল্প পানি জমে থাকে। এ সময় সেখানে মশার বংশবিস্তার ঘটে। দিনের বেলা মশার দাপট না থাকলেও রাতের বেলা বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থাপনায় ঢুকে পড়ে মশা। প্রচুর বৈদ্যুতিক আলো ও প্রবেশপথ খোলা থাকায় মূল টার্মিনালে সন্ধ্যার পরপরই মশা ঢুকে পড়ে। রাতে আউট-বে এলাকায় উড়োজাহাজ থামার পর যাত্রীদের বহনকারী বাস আসতে মিনিট পাঁচেক দেরি হয়। সে সময় উড়োজাহাজ থেকে নামার পর মশার ঝাঁক রীতিমতো যাত্রীদের ঘিরে ধরে।

হাতে হামলে পড়েছে মশা। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার

আন্তর্জাতিক টার্মিনালে চারটি এবং অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে একটি করে ভিআইপি কক্ষ রয়েছে। এসব কক্ষ পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে রয়েছে এ কে ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান। মশার কবল থেকে ভিআইপিদের রক্ষা করতে কক্ষ পাঁচটিতে প্রতিদিন ৩০ বোতল ওষুধ স্প্রে করতে হয়। এমন কথা জানালেন এ কে ট্রেডার্সের কর্মকর্তা মো. মামুন। তিনি বলেন, ব্যাট দিয়ে মশা মারা হয়। নেটও রয়েছে। তবু মশা আসে। ঠেকানো যায় না। ভিআইপিদের সংখ্যা বেশি হলে কোনো কোনো দিন মশা মারতে ৩৫ বোতল অ্যারোসল স্প্রে করতে হয়।

মশার কাছে হার মানেন বৈমানিকেরাও
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে এখন সুপরিসর উড়োজাহাজ আছে বেশ কিছু। ৪১৯ আসনের বোয়িং ৭৭৭-৩০০, প্রায় পৌনে দুই শ আসনের বোয়িং ৭৩৭, আরও আছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার। যতই আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে গড়া হোক না, শাহজালাল বিমানবন্দরে মশার ঝাঁককে ঠেকিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা নেই এসব উড়োজাহাজের।

এ নিয়ে কথা হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কয়েকজন বৈমানিকের সঙ্গে। মশা নিয়ে অভিজ্ঞতার কথা জিজ্ঞেস করতেই হেসে ওঠেন এক বৈমানিক। ওই বৈমানিক বলেন, ‘কী আর করব! বিমানে উঠে প্রথমেই মশা মরতে থাকি। ককপিটে তো মশা মারার ব্যাট নেওয়ার অনুমতি নেই। তাই মশার কামড় থেকে রক্ষার জন্য ক্রিম মেখে নিতে হয়। ককপিটে বসার আগে মশা মারার ওষুধ স্প্রে করে দরজা বন্ধ করে বাইরে চলে যেতে হয়। টেক অফের কিছু সময় আগে এসে ককপিটে ফেরত আসি। এ কাজ শুধু ঢাকায় বিমানবন্দরে করতে হয়।’

মশার আক্রমণ থেকে শিশুকে রক্ষার চেষ্টা করছেন তিনি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার

ককপিট থেকে কিছুটা রক্ষা পেলেও যাত্রীদের আসনের অংশে কেবিন ক্রুদের আরও বিপত্তিতে পড়তে হয়। মশার ঝাঁক যেমন কানের পাশে ভোঁ ভোঁ শব্দ করে ঘিরে রাখে, তেমনি যাত্রীরাও কটুবাক্য ছুড়ে দিতে দ্বিধা করেন না। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে মালয়েশিয়া রওনা হওয়ার সময় কথা হয় বিমানের এক কেবিন ক্রুর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভাই, হাতে স্প্রে নিয়ে বিমানের ভেতরে যাচ্ছি। মুখ খুললেই অনেক সময় মশা ঢুকে যেতে পারে।’

মশার বাধায় উড়োজাহাজের যাত্রা ভঙ্গ
শাহজালাল বিমানবন্দরে উড়ন্ত উড়োজাহাজের গতি মন্থর করে তা থামিয়ে দেওয়ারও নজির আছে। ২০১৮ সালের ২৩ জুন দিবাগত রাতে একঝাঁক মশা থামিয়ে দেয় মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ। ওই দিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার কথা ছিল মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের এমএইচ ১৯৭ নম্বর ফ্লাইটের। বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজটিতে দেড় শ যাত্রী ছিলেন। যাত্রীদের নিয়ে উড়োজাহাজটি রানওয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ উড়োজাহাজের ভেতরে থাকা যাত্রীরা মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে যান। যাত্রীদের অভিযোগে আকাশে ডানা মেলার ঠিক আগমুহূর্তে আবার বে এরিয়ায় ফিরে আসে উড়োজাহাজটি।

বে এরিয়ায় ফিরে আসার পর মশা নিধন শুরু হয়। কেবিন ক্রুরা ওষুধ ছিটিয়ে এ কাজ করতে থাকেন। ওষুধ ছিটানোর পর মশার দাপট কমে আসে। পরে প্রায় দুই ঘণ্টা দেরিতে রাত পৌনে তিনটার দিকে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ফ্লাইটটি গন্তব্যের দিকে রওনা হয়।

শরীরে বসা মশা তাড়ানোর চেষ্টা তাঁর। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার

মাহমুদুল হাসান, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসে কাস্টমার সার্ভিস অফিসার হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিল শাহজালাল বিমানবন্দরে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসের দিকে ডেঙ্গু ধরা পড়ে তাঁর শরীরে। পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লেগে যায় এক মাস। এরপর আবার তাঁর উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে। শেষ পর্যন্ত পাঁচ বছরের চাকরিটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘মশার কারণে রাতের বেলা কাজই করা যেত না। আমার মতো বাংলাদেশ বিমানের এক কর্মকর্তাও একই সময় ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। ডেঙ্গুর পর আমি উচ্চ রক্তচাপে ভুগতে থাকি। তাই চাকরি করা সম্ভব হয়নি।’

যাত্রী, দর্শনার্থী ছাড়া রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রায় প্রতিদিনই সবার আসা-যাওয়া চলে। তাঁদের নিরাপত্তা দেখভালের পাশাপাশি পুরো বিমানবন্দরে কড়া নজরদারিতে রাখতে হয় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যদের। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা পালা করে প্রহরায় থাকেন তাঁরা। বিমানবন্দর এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন বলেন, প্রতিবছর গড়ে সাত মাস মশার দাপট থাকে শাহজালাল বিমানবন্দরে। অক্টোবর মাস শুরু হতে না হতেই মশার উপদ্রব শুরু হয়। শীতকালে তা সহ্যের বাইরে চলে যায়। এপ্রিলের পর বৃষ্টি হলে মশার দাপট কিছুটা কমে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা রক্ষা করাই আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু যাত্রীরা মনে করেন মশা মারার কাজটিও আমাদের। তাই মশা নিয়ে যত অভিযোগ যাত্রীরা আমাদের শুনিয়ে থাকেন।’

কর্তৃপক্ষ যা বলছে, যা করছে
বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল্লাহ আল ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, মশা মারতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দুটি প্রকল্পও চলছে। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে কার্যক্রম নিয়েছে। বিমানবন্দর এলাকার জলাশয় জঙ্গল পরিষ্কার করানো হয়েছে। নিয়মিত টার্মিনাল এলাকায় ফগার মেশিনে করে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। তবে মশার জন্ম বিমানবন্দর এলাকার বাইরে উত্তর দিকে আশুলিয়ায়। মশার ব্রিডিং গ্রাউন্ডগুলোও সেখানে। এসব এলাকা থেকে মশা বিমানবন্দরের দিকে এলে তো আটকানো যায় না। সিটি করপোরেশন বলছে, তারা বিমানবন্দরসংলগ্ন আশুলিয়ার দুই কিলোমিটার এলাকা পরিষ্কার করে দেবে।

শরীরের ফাঁকা জায়গা পেলেই বসে পড়ে মশা। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার

তবে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ জানায়, অনুমতি না থাকায় বিমানবন্দর এলাকায় তারা মশা মারতে পারছে না।

ডিএনসিসির প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু কিছু জায়গা যেমন বিমানবন্দর, ওখানে মশার ওষুধ দিতে পারি না। নিরাপত্তার বিষয় আছে। এ জন্য বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। পাশে সেনানিবাস আছে। সেখানেও অনুমতি ছাড়া যাওয়া যায় না। তবে বিমানবন্দরের আশপাশের বাসাবাড়িতে ছাদে গাছের টব আছে। এসির পানি জমে। মশা সেখানে হয়। যেখানে আমাদের লোক যেতে পারে না। তবে আমরা নিয়মিত ড্রেনে মশার ওষুধ ছিটিয়ে থাকি। মশা মারতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ যদি চিঠি দেয়, তখন আমরা আদেশ দিয়ে সেখানে লোক পাঠাব।’