লকডাউনে মায়ের না-বলা কথা

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com

জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি আমরা সবাই শ্রম দিই। কেউ মা হয়ে, কেউ বাবা, কেউ ছেলে, কেউবা মেয়ে, কেউ কৃষক, চাকরীজীবি ইত্যাদি পেশায় আমরা আজীবন শ্রম ব্যয় করি।

শ্রমিকের কর্মপ্রচেষ্টাতেই প্রতিটি শ্রমই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই পৃথিবীতে শ্রমানুযায়ী সব শ্রমিকের মূল্যায়ন কিন্তু আবার এক হয় না।

একজন নারী যখন মা হয়, তখন থেকেই তার জীবনের আসল শ্রম শুরু হয়। বাচ্চা লালনপালন থেকে শুরু করে বড় করা, বিয়েশাদি দেওয়া আর এখনকার যুগে তো বিয়ে দিয়েই অনেক মা-ই অবসরে যেতে পারেন না। বিয়ের পর তাঁকে হয় তার মেয়ে বা ছেলের বাচ্চাদেরও দেখভালের দায়িত্ব নিতে হয়। আধুনিক যুগে তাই একজন দাদা-দাদি বা নানা-নানির ওপর অধিকাংশ পরিবার নির্ভরশীল। আর এই নির্ভরশীলতার একটা বড় কারণ নাতি-নাতনিদের দেখভালো করা। তবে এসব কাজে একজন পুরুষের চেয়ে একজন নারীর ভুমিকাই বেশি।

আবার এমনও দেখা যায়, একজন নারী যখন বৃদ্ধ হয়, তখনো তার কাজ থেমে নেই। তাকে তার বৃদ্ধ স্বামীর জন্য একজন অপরিহার্য শ্রমিক হিসেবে খেটে যেতে হয়। কাজেই দেখা যায়, একজন নারীর মৃত্যুর আগপর্যন্ত কোনো অবসরই থাকে না।
আজ লকডাউনে এমনই এক মায়ের (আমার) গল্প তুলে ধরেছি।

বর্তমানে বিশ্বে বহুরূপী করোনাভাইরাস মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে কয়েক রূপে যেমন ছোবল মেরেছে, তেমনি বাহ্যিক দিক দিয়েও বহু রূপ দেখিয়েছে। যার একটা বড় প্রভাব পড়েছে মানুষের পারিবারিক জীবনে। কারণ সবাই এখন ঘরবন্দী। করোনার প্রভাবে কাজের ছুটা বুয়াও বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে সবাই। আর এই ঘরবন্দী জীবনে একজন মাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে একজন ছুটা বুয়ার পাশাপাশি একজন বাঁধা বুয়া হিসেবে।

হঠাৎ চোখের কোণে ব্যথা। সময় যত গড়াচ্ছে ব্যথাও তত তীব্র হচ্ছে। তবুও ঘরের কাউকে বুঝতে দিলাম না। সামনের দিকে ঝুঁকতেই মনে হলো পুরো চোখটাই ছিটকে পড়বে। কোনো রকম ঘরটা মুছলাম। এবার আর ব্যথা সহ্য করতে না পেরে শুয়ে পড়লাম। আমার মেয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, আম্মু? বললাম, তেমন কিছু না। এদিকে ইফতারের সময় হয়ে আসছে।

শোয়া থেকে উঠতেই আবারও চোখে ব্যথা। কিন্তু উপায় নেই। রান্নাঘরে গিয়ে চুলা জ্বালাতেই চোখের ব্যথাটা বেড়ে গেল। ভাবলাম, স্বামী, ছেলে, মেয়েকে গিয়ে বলি, আজ ওরাই ইফতার তৈরি করুক। কিন্তু গিয়ে দেখি, সবাই সবার মতো নেট নিয়ে ব্যস্ত। সবাই তো ভালোই আছে, হাসিখুশি।

ভাবলাম, একে তো করোনা, তার ওপর সবাই ঘরবন্দী। এমনেই একঘেয়ে জীবন। তার ওপর আমি যদি বলি আমার অসুস্থতার কথা, তাহলে বাচ্চারা চিন্তায় পড়বে, মন খারাপ করবে। তার চেয়ে ভালো চুপ করে সহ্য করি।


খুব কষ্ট করে ইফতারি তৈরি করলাম। এদিকে চোখটাও কিছুটা ফুলে আছে। সবাই টের পাবে তাই যতটা সম্ভব চোখটাকে আড়াল করার চেষ্টায় থাকলাম।

ইফতারের পর আরও ব্যথা। এদিকে শুয়ে থাকলে কি চলবে! এই ব্যথা নিয়েই কোনোভাবে কাজ করছি। রাতে নামাজ পড়ে যে যার মতন শুয়ে পড়ল। আমিও চেষ্টা করলাম ঘুমাতে। কিন্তু চোখ কিছুতেই বন্ধ করতে পারছি না ব্যথায়। আবিষ্কার করলাম, চোখের কোণে ছোট্ট একটা বিচির মতো। হায়! একটা ছোট্ট ফোঁড়াও যে একমুহূর্তে এত বিশাল শরীরটাকে কাবু করে ফেলতে পারে, ভেবে অবাক হলাম। আর কোনোভাবেই ব্যথা সহ্য করতে পারছি না। রুমে পায়চারি করলাম।

ভাবলাম, আমার সাহেবকে উঠাব কি না। ওর চেহারার দিকে তাকাতেই মায়া লেগে গেল—গভীর ঘুম! ছেলেমেয়েকে বলেও কী লাভ! ওরাও ছোট।

ভীষণ কষ্টের একপর্যায়ে নাপা খেলাম। আবার পায়চারি আর দোয়া পড়ছি। অনেকক্ষণ পর কিছুটা ব্যথা কমল, ব্যথা নিয়েই শুয়ে পড়লাম। তেমন ঘুম হলো না বলে মাথাও ব্যথা। সাহ্‌রিতে উঠলাম। সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া শেষ করলাম। আস্তে আস্তে ব্যথাটাও বাড়ছে।


ভাবছি, এবার সবাইকে বলি। কিন্তু দেখলাম, ছেলেমেয়ে ওদের বাবার সঙ্গে দুষ্টুমি করছে, নিজেরা ভাইবোন খুনসুটি করছে। মাশা আল্লাহ! দেখতে ভালোই তো লাগছে। তাই আবারও বলতে গিয়ে পারিনি।

হঠাৎ মাথায় এল, একবার আমার ছেলের চোখে অঞ্জনি উঠেছিল। তখন ডাক্তার ওকে যে ট্রিটমেন্ট দিয়েছিল, সেই ট্রিটমেন্ট অনুসরণ করলে কেমন হয়, কিন্তু ভয় হলো ভেবে যে, আমার এটা যদি অঞ্জনি না হয়ে অন্য কিছু হয় তাহলে!


নাহ! ভাগ্য ভালো, কিছু বরিক পাউডার রয়ে গেছে। আর পারছি না, তাই শুরু করলাম গরম পানিতে বরিক পাউডার দিয়ে ছ্যাঁক দেওয়া।

ভীষণ উম পেতে লাগলাম। কেউ যাতে টের না পায়, তাই কেউ রুমে না থাকলে তখন ছ্যাঁক দিতাম। এভাবে কয়েকবার দিলাম। মাঝে এক–দুবার সবাই টের পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে। পাশ কাটিয়ে বললাম, তেমন কিছু না।

আলহামদুলিল্লাহ, পরের দিন সকালে খেয়াল করলাম, পুঁজ হয়েছে। পুঁজটা বের হতেই মনে হলো, শরীরের ওপর থেকে এক বিশাল বোঝা নেমে গেল।

আলহামদুলিল্লাহ, সুস্থ হয়ে ওঠার পর চিন্তা করে দেখলাম, কী হতো যদি আমি হাত গুটিয়ে শুয়ে থাকতাম বাসার সবার ওপর কাজের ভার চাপিয়ে দিয়ে। আসলে আমি তো মা, মায়েরা তো এমনই হয়! নিজের হাজারো কষ্ট আড়াল করে ঘরের সবাইকে ভালো রাখতে।


মায়েরা তো এমনই হয়, মায়েদের কাছে বাচ্চারা এসে বলতে পারে, মা ভালো লাগছে না, এটা খেতে ইচ্ছে করছে, ওটা খেতে ইচ্ছে করছে। ঘরের কর্তাও বলতে পারে কিছু সুখদুঃখের কথা, বলতে পারে এক কাপ চা বানিয়ে দাও। কিন্তু কজন মা পারে বলতে, তারও যে ভালো লাগছে না, বোরিং লাগছে। কজন মা-ই বা পারে একটি দিন সংসারের কাছ থেকে ছুটি নিতে!

আমার ছেলে যখনই করোনার সংবাদ পায়, আমাকে জানায়, সংক্রমণ, মৃত্যু বেশি দেখলে অনেকটা নার্ভাস লাগে ওর। তখন ওকে সাহস দিয়েছি। বলেছি, জন্ম হয়েছে যখন, মৃত্যু আসবেই। আমাদের সবাই কেই একদিন বিদায় নিতে হবে। এটাই বাস্তব। কেন চিন্তা করছ।তুমি নামাজ পড়ো, ভালো কাজ করো আর আল্লাহকে ডাকো। ইনশা আল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। এরপরও যদি আল্লাহ মাফ করুক মৃত্যু এসে যায়, সেটা আল্লাহর ফয়সালা। এটাকে মেনে নেওয়াই একজন মুমিনের কাজ। খেয়াল করলাম, ছেলেমেয়ে একটু হলেও মনোবল ফিরে পেয়েছে।


কিন্তু আমার কি কথাগুলো বলতে বুক কাঁপেনি, খারাপ লাগেনি! কিন্তু আমাকে কে এমন করে সাহস দেবে!

এই লকডাউনে ওদের কোনো কাজে বাধা দিইনি। যখন ইচ্ছে ঘুমিয়েছে, যখন ইচ্ছে উঠেছে। ঘরের সবাই অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠত। আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে আগে উঠে ঘরের কাজের প্রস্তুতি নিতাম। ইচ্ছা হতো সবাইকে জাগিয়ে দিই আমাকে কাজে সহযোগিতা করার জন্য। আবার ভাবি, এভাবে প্রতিদিন রুটিন করে ঘুম থেকে ওঠালে, একই রকম ঘরের কাজ করালে ওদের একঘেয়েমি আরও পেয়ে বসবে। তা ছাড়া পানির কাজ করালে যদি ঠান্ডা লেগে যায়!

তাই নিজেই একঘেয়ে সংসারের কাজের বোঝা চেপেছি। সব সময় কি আর শরীর চলত! কিন্তু তবুও তো ওদের মুখের দিকে চেয়ে, পরিবারের সবার ভালোর কথা চিন্তা করে নিরবে নিভৃতে সব কষ্ট সয়েছি।

ওদের সঙ্গে লুডু খেলেছি, দুষ্টুমিও করেছি অনেক। উৎসাহ দিয়েছি সৃজনশীল কাজের। সব সময় চেষ্টা করেছি ওদের পছন্দের খাবার তৈরি করতে, একেক দিন একেক খাবার তৈরি করতে। ওদেরও ঘরের কাজ দিয়েছি কিছু, কিন্তু বেশি কোনো কাজই দিইনি ওদের কষ্ট হবে ভেবে। ওরা সাহায্য করতে চাইত আমার কষ্ট দেখে, কিন্তু আমি হাসিমুখে উড়িয়ে দিতাম। ওরা তো জানে না, ঘরের কাজও যে কম কষ্টের না!

মায়েরা তো আসলে এমনই হয়! নিজের জন্য দোয়ার চেয়ে সন্তানের জন্য বেশি করে দোয়া করে। আর এই মহামারিতে তো আরও বেশি করে সব মায়েরাই তাদের সন্তানদের জন্য দোয়া করেছে। মাঝেমধ্যে খুব চিন্তিত হয়ে পড়তাম ভেবে, কী জানি! যদি আল্লাহ মাফ করুক আমার কিছু হয়ে যায়, তাহলে আমার সন্তানদের কী হবে? মায়ের অভাব কি পৃথিবীর কোনো কিছু দিয়ে তুলনা করা যায়!

যাই হোক, লকডাউন উঠে যাবে, হয়তো আল্লাহ চাইলে পৃথিবী করোনামুক্তও হয়ে যাবে। পত্রিকায়, টিভিতে, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও হয়তো এই সংবাদ আসবে যে করোনাকালে কিছু পুলিশ, ডাক্তার, সমাজসেবী মানুষের কথা, যাঁরা নিরলস প্রচেষ্টা করে করোনা রোগীদের সেবা দিয়েছেন। হয়তো তাঁদের সম্মানীতও করা হবে।

কিন্তু লকডাউনের এই কঠিন সময়ে ঘরে থেকে একজন মা যেভাবে তাঁর সন্তানদের সাহস দিয়ে, যত্ন করে আগলে রাখতে যে যুদ্ধ করেছেন প্রতিনিয়ত, সেই মায়ের কথা সমাজের কজন মানুষ স্মরণ করবে!


কেউ স্মরণ করুক বা না করুক, যেহেতু আমি একজন মা, তাই আমার পক্ষ থেকে সব মায়ের জন্য দোয়া আর শুভেচ্ছা রইল, ভালো থাকুক পৃথিবীর সব মা।

*গৃহিণী, গ্রিন রোড, ঢাকা। zm1432002@yahoo.com