প্রায় দুই মাস ধরে বন্দী জীবন যাপন করছেন হোটেল কর্মচারী জিলানী জমাদ্দার। হোটেল বন্ধ থাকায় তাঁর আয় একেবারই বন্ধ। ফলে দুই মাসের ঘরভাড়া দিতে পারেননি। এত দিন ধারদেনা করে সংসার চালাচ্ছিলেন। তবে এখন তিন ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।
রামপুরার খানাবিলাসী হোটেলের কর্মচারী জিলানী জমাদ্দার বলেন, ‘করোনার কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে আমার হোটেল বন্ধ। হোটেলে চাকরি করে যে টাকা বেতন পেতাম, সেই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হতো। আর দুই মাস ধরে ঘরে বসা। মানুষের কাছে ধারদেনা করে এত দিন চলছি। এখন আর চলতে পারছি না। শুনছিলাম, সরকার আমাগো প্রণোদনা দেবে। কিন্তু কোনো টাকায় তো পেলাম না।’
বিল্লাল হোসেন রাজধানীর মিরপুরের টোলারবাগের সমবায় বাজার অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের একজন কর্মচারী। ২০ বছর ধরে তিনি এই পেশায় রয়েছেন। দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে মিরপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। করোনায় প্রায় দুই মাস ধরে হোটেল বন্ধ থাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘করোনায় হোটেল বন্ধ থাকায় আমরা বড় বিপদে পড়ে গেছি। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, এখন আর কেউ ধার দিচ্ছে না। আর সংসারের খরচ মেটাতে পারছি না।’
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি ও ঢাকা মহানগর শ্রমিক লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা মহানগরের হোটেল রেস্তোরাঁর ৬০ হাজার কর্মচারী রয়েছেন। করোনায় দুই মাস ধরে ঢাকার অধিকাংশ রেস্তোরাঁ বন্ধ। ফলে বেকার হয়ে পড়েছেন কর্মচারীরা। তাঁরা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
ঢাকা মহানগর হোটেল শ্রমিক লীগের সভাপতি মো. আল আমিন বলেন, ‘দুই মাস হতে চলল, আমাদের আয় বন্ধ। অধিকাংশ হোটেল এখন বন্ধ। কবে খুলবে জানি না। আমাদের ৬০ হাজার হোটেল কর্মচারীর কাজ নেই, বেতন নেই। সরকারের তরফ থেকে প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রণোদনার অর্থ আমরা আজও পাইনি।’
আল আমিনের অভিযোগ, শ্রম আইন অনুযায়ী হোটেলের কর্মচারীরা সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার হকদার হলেও কোনো কিছু তাঁরা পাচ্ছেন না। হোটেলমালিকেরা কোনো হোটেল কর্মচারীকে নিয়োগপত্র বা পরিচয়পত্র দেন না। হোটেলের কর্মচারীদের প্রণোদনা পাওয়ার যে তালিকা করা হয়েছে, তা পরিপূর্ণ তালিকা নয়। মালিকেরা তাঁদের মতো করে সরকারের কাছে তালিকা পাঠিয়েছেন। ফলে বাদ পড়েছেন বহু হোটেল কর্মচারী।
কয়েকজন হোটেলশ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, হোটেলমালিকের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার নিয়োগপত্র বা পরচিয়পত্র দেওয়া হয় না কর্মচারীদের। ফলে শ্রম আইনের কোনো সুযোগ-সুবিধা তাঁরা পাচ্ছেন না। রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি খন্দকার রুহুল আমিন বলেন, ‘হোটেল-রেস্টুরেন্ট শিল্প ক্যাটাগরিতে পড়ে না। শিল্প ক্যাটাগরিতে না থাকায় কোনো হোটেল কর্মচারীকে নিয়োগপত্র বা আইডি কার্ড দেওয়া হয় না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে হোটেল-রেস্টুরেন্টকে শিল্প ঘোষণা করার জন্য আবেদন করা হয়েছে। হোটেল-রেস্টুরেন্টকে শিল্প ক্যাটাগরি ঘোষণার পর শ্রমিকদের নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড দেওয়া হবে। তবে নিয়ম অনুযায়ী কোনো শ্রমিককে পাওনা থেকে বঞ্চিত করে না মালিকপক্ষ।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী হোটেল-রেস্টেুরেন্টের শ্রমিকেরা সব সুযোগ–সুবিধা পাওয়ার দাবি রাখেন। আইন অনুযায়ী, তাঁদের প্রত্যেককে নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড দেওয়া উচিত। সব হোটেল কর্মচারীকে সরকারি সহায়তার আওতায় আনা উচিত।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায় বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী, হোটেল-রেস্টুরেন্টের প্রত্যেক শ্রমিককে আইডি কার্ড ও নিয়োগপত্র দিতে বাধ্য মালিকপক্ষ। একই সঙ্গে প্রতিটি হোটেল-রেস্টুরেন্টে কর্মচারীদের নাম, পদবিসংবলিত রেজিস্ট্রার রাখতে হবে। ওই রেজিস্ট্রার অনুযায়ী, প্রণোদনার পাওয়ার জন্য শ্রমিকদের তালিকা প্রস্তুত করা দরকার। এ ব্যাপারে শ্রমিকদের প্রণোদনার অর্থ পাওয়ার তালিকা যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি বলছে, ঢাকার অভিজাত এলাকায় কিছু হোটেল-রেস্টুরেন্ট খোলা থাকলেও ৯৫ ভাগ হোটেল বন্ধ। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শ্রমিকদের পাশাপাশি মালিকেরাও বিপাকে রয়েছেন। যে যেভাবে পারছেন, শ্রমিকদের সাহায্য করার চেষ্টা করছেন। রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি খন্দকার রুহুল আমিন জানান, করোনায় হোটেলমালিকেরাও বিপদে পড়েছেন। হোটেলের শ্রমিকদের প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মালিকেরা কোনো প্রণোদনার আওতায় আসেননি। অধিকাংশ হোটেল কর্মচারীর জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। ফলে প্রণোদনার অর্থ পাওয়ার তালিকা থেকে তাঁরা বাদ পড়েছেন। যাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে, কেবল তাঁদের নামের তালিকা করা হয়েছে। হোটেল কর্মচারীদের প্রণোদনা পাওয়ার সেই তালিকা ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে।
কবে নাগাদ সেই প্রণোদনার অর্থ আসবে, তা জানেন না রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির নেতা খন্দকার রুহুল আমিন।