রোববার রাত ১০টার কিছু বেশি। কর্মব্যস্ত মানুষ ফিরছে ঘরে। হাতে লম্বা ঝাড়ু নিয়ে রাস্তায় নামলেন আলেয়া বেগম। পথচলতি মানুষ যেতে যেতে অবলীলায় ছুড়ে ফেলেন ঠোঙা, কাগজ, প্যাকেট, খোসা, কত কী! দিনভর নগরবাসীর জমিয়ে তোলা সেসব ময়লা–আবর্জনা রাস্তা থেকে সাফ করে ঘরে ফেরেন আলেয়া।
১৯ বছর ধরে ঢাকার রাস্তায় সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করছেন আলেয়া। থাকেন হাজারীবাগ এলাকায়। এই কাজটা কেমন লাগে জানতে চাইলে বলেন, ‘এটা তো কাজ, কাজ তো করতেই হবে, ভালোই তো লাগে।’
নারী দিবসের কথা কিছু জানেন? এমন প্রশ্ন শুনে একচোট হাসলেন আলেয়া। বললেন, ‘আমরা তো জানি না, আমরা তো মুরখু মানুষ। আমরা এসব বলতে পারি না। আমরা খালি ঝাড়ু দিতে পারি।’
তাঁর সঙ্গেই ছিলেন দূর সম্পর্কের ননদ, রাহিমা বেগম তিনিও একই কাজ করেন। তাঁরা দুজনেই জানান, সারা বছর যত উৎসব–আয়োজন থাকুক না কেন, তাঁদের কোনো ছুটি নেই। কেবল অসুখ-বিসুখ হলে অন্য কারও সঙ্গে অদল-বদল করে নিতে পারেন, এটুকুই। করোনার সময় কাজ আরও বেশি করতে হয়েছে বলে জানান তাঁরা।
পান্থপথ থেকে সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত ঝাড়ু দিতে দিতে কখনো ঝিমুনি এলে বসে এক কাপ চা খেয়ে নেন। এই প্রতিবেদককেও টেনে নিয়ে গেলেন চা খাওয়াতে। চা খাওয়াতে যেখানে নিয়ে গেলেন, সেখানেও চা–বিক্রেতা একজন নারী।
ব্যস্ত সড়কের মোড়ে আট বছর আগে চায়ের দোকান দিয়েছিলেন রিনা বেগম। তাঁকে দেখে পাশে আরও কয়েকজন বসেছেন চা-বিস্কুট নিয়ে। এই নারীদের কাজে সহায়তা করেন তাঁদের কারও স্বামী, কারও ছেলে। রিনা বেগম বলেন, নারী দিবস–টিবসের কথা শুনি, লোকজন চা খেতে খেতে আলাপ-আলোচনা করে।
ঘর থেকে বেরোনোর সময় আজ হয়তো কর্মজীবী নারীটি কিংবা সচেতন শিক্ষার্থী বেগুনি বা পার্পেল রঙের পোশাকটি বেছে নেবেন। কারণ সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘নেতৃত্বে নারী: কোভিড-১৯ বিশ্বে সমতাপূর্ণ ভবিষ্যৎ গড়া’। দেশের এগিয়ে থাকা নারীদের তাঁদের অধিকার ও ভবিষ্যৎ ভাবনার বিষয়ে হয়তো আরও একবার জাগিয়ে তুলবে এই উদ্যাপন। কিন্তু পিছিয়ে থাকা অংশের এই নারীদের কাছে নারী দিবস কতটা অর্থবহ!
সন্তানসম্ভবা মাহমুদা আক্তার (রহিমা) থাকেন হাজারীবাগ এলাকায়। সেখান থেকে প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় আসেন কাজ করতে। আট বছর বয়স থেকে গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন। তিনটি বাসায় কয়েক ঘণ্টা করে কাজ করে যে টাকা রোজগার করেন, তা মায়ের হাতে তুলে দেন। তিনি স্বামীর কাছে শুনেছেন আজ নারী দিবস। এটুকুই শুধু তিনি জানেন। আর তা ছাড়া জেনে কী হবে! বেশি কথা বলে সময় নষ্ট করার ফুরসত-ই বা কোথায়!
শিক্ষিত, সচেতন নারীরা যেভাবে নিজেদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে নিচ্ছেন, তেমনি এই নারীরাও খুঁজে নিচ্ছেন তাঁদের জীবিকার পথ। কারও স্বামী হয়তো রিকশাচালক, নিরাপত্তাপ্রহরী কিংবা প্রতিবন্ধী অথবা খোঁজই নেই। এই লেখাপড়া না জানা নারীদের রোজগারের টাকায় চলছে মাথার ওপর সামান্য ছাদটুকুর ভাড়া, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া।
কেউ কেউ গ্রামে টিনের ঘর তুলেছেন, একদিন হয়তো ফিরে যাবেন সেখানে। তবে এটা ঠিক, যে জীবন তাঁদের কেটেছে, তেমন জীবন সন্তানের জন্য কাম্য নয় তাঁদের। একদিন হয়তো আসবে, যেদিন এই মায়েদের কন্যারা হয়তো নারী দিবসের কথা শুনলে আর আচমকা হেসে উঠবে না।