সাড়ে ৩৯ কেজির কাঁঠাল, এক আমের তিন রকম স্বাদ, ৫০-এর বেশি জাতের আম, করমচা, কতবেল, অরবরই, ডুমুর, ডেউয়া, কামরাঙা, কাউফল, তাল, গাব, লটকনসহ নানা জাতের দেশি ফল; পাহাড়ি ফল প্রেজাম; সিংহলী নারকেল; অ্যাভোকাডো, বাক্স বাদাম, কফি বিনসহ হরেক রকমের বিদেশি ফল।
এ রকম দেশি-বিদেশি প্রজাতির ফল নিয়ে রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে চলছে তিন দিনব্যাপী জাতীয় ফলমেলা। গতকাল বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া এই মেলা আগামীকাল শনিবার শেষ হবে। সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য এই মেলা খোলা থাকছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৬৭টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে।
আজ কাদা-বৃষ্টি মাড়িয়ে অনেকেই এই মেলায় আসেন। আগত শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সী মানুষ চেনা-অচেনা এত ফলের সমাহার দেখে ছিল উচ্ছ্বসিত।
মেলার প্রবেশমুখেই সাড়ে ৩৯ কেজির একটি কাঁঠাল। ময়মনসিংহের কেওয়াটখালী হর্টিকালচার সেন্টারে এই কাঁঠালটি হয়েছে।
এরপর বাঁ দিকে ঘুরলেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের স্টল। মেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় এই স্টলে করমচা, কতবেল, অরবরই, ডুমুর, ডেউয়া, কামরাঙা, কাউফল, তাল, গাব, লটকন, খেজুর, আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, প্রেজাম (পাহাড়ি ফল), সিংহলী নারকেল, লালী বাঙ্গি, আমলকী, লুকলুকি, পানিয়ল, মিষ্টি তেঁতুল, চাপালিশ, আলুবোখারা, রামবুটান, প্যাসন, অ্যাভাকাডো, বাক্স বাদাম, কফি বিন, কাজুবাদামসহ দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির ফল। সেখানে ৫০টির বেশি প্রজাতির কেবল আমই রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার শাখার উদ্যান উন্নয়ন কর্মকর্তা এ বি এম শাহ এমরান জানান, তাদের স্টলে প্রায় ২০০ প্রজাতির ফল রয়েছে। এই দেশি-বিদেশি প্রজাতির সব ফলই দেশে উৎপাদিত হয়।
বেসরকারি চাকরিজীবী মো. মোশারফ হোসেন স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে এই মেলায় আসেন। তিনি বলেন, তাঁর ইচ্ছা ছিল এ রকম একটি ফলমেলায় আসার। মোশারফ বলেন, ‘এখানে অনেক ফল দেখেছি, যা জীবনে প্রথম দেখলাম। কাজুবাদাম ফল, কফি বিন, প্যাসন—এ রকম অনেক ফল প্রথম দেখলাম।’
মোশারফ হোসেনের ছেলে মো. নাবিয়ীল হোসেন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। নাবিয়ীল বলে, ‘সাড়ে ৩৯ কেজি ওজনের কাঁঠাল দেখেছি। এত বড় কাঁঠাল দেখি নাই। আর এত ফল দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।’
নানা জাতের ফল উদ্ভাবন করে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। তাদেরও একটি স্টল রয়েছে মেলায়। এই ইনস্টিটিউটের ফল বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমান জানান, গত এক থেকে দেড় বছরে তাঁরা মোট ১৩টি জাতের ফল উদ্ভাবন করেছেন। নতুন উদ্ভাবিত এসব ফল হলো বারি আম-১২ থেকে ১৮, বারি লেবু-৬, বারি মাল্টা-২, বারি কাঁঠাল-৪, বারি জাম-১, বারি আতা-১ ও বারি ফলসা-১। তার মধ্যে জাম, আতা ও ফলসার নতুন জাত এবারই প্রথম উদ্ভাবিত হয়েছে।
জিল্লুর রহমান জানান, এখন পর্যন্ত তারা ৩৮ ধরনের ফলের মোট ৯৭টি জাত উদ্ভাবন করেছেন। এগুলোর মধ্যে ২০টি জাত বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাদের উদ্ভাবিত ফলের ফলন আগের জাতের চেয়ে বেশি। এসব ফলমেলায় স্থান পেয়েছে।
নতুন নতুন ফলের জাত তৈরিতে কাজ করছে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনও। বিদেশ থেকে ফল এনে বাংলাদেশের আবহাওয়ার উপযোগী করছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া একটি প্রজাতির সঙ্গে আরেকটি মিলিয়ে নতুন প্রজাতি তৈরি করছে। তাদের স্টলে এ রকম ৭৫টি প্রজাতির ফল রয়েছে বলে জানান এই করপোরেশনের সহকারী পরিচালক কৃষিবিদ মিমি তালুকদার। তিনি বলেন, এসব ফল এখন দেশে চাষ হচ্ছে।
কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের স্টলে দেখা যায় কোকো ফল, যা থেকে চকলেট উৎপাদন করা হয়। এক আমে তিন রকম স্বাদ থ্রি-টেস্ট আমে। ভিয়েতনামি কাঁঠাল, যাতে নেই কোনো আঠা। এ রকম অসংখ্য ফল কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের স্টলে।
৩৫টির বেশি প্রজাতির ফল নিয়ে মেলায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের স্টল। এখানে কাঁঠাল দিয়ে তৈরি ২০ ধরনের খাবার রাখা হয়েছে। যেমন কাঁঠালের বড়া, কাঁঠালের কাপকেক, কাঁঠালের কাবাব, কাঁঠালের নিমকি, কাঁঠালের পায়েস, কাঁঠালের পাতাপিঠা, কাঁঠালের শুঁটকির বড়া প্রভৃতি।
এই অধিদপ্তরের উপপরিচালক ইকবাল হোসেন চাকলাদার বলেন, দেশে যে পরিমাণ কাঁঠাল উৎপাদিত হয়, তার প্রায় ৫০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। অথচ কাঁঠাল দিয়ে অনেক খাবার বানানো যায়। এসব খাবার জনপ্রিয় হলে অপচয় কম হবে। তিনি বলেন, সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন ২০০ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। অথচ এখন বাচ্চারা ফল কম খায়। তারা ফাস্ট ফুড বেশি খায়। তারা মেলায় এলে ফল খাওয়ার প্রতি উৎসাহিত হবে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফল নিয়ে মেলায় এসেছেন অনেকে। সেসব দোকান থেকে ফল কেনাও যায়। মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলা থেকে ৯ প্রজাতির ফল নিয়ে এসেছেন কাজী আকরাম। তিনি জানান, এসব ফলে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়নি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. তৈয়ব আলী বলেন, মেলায় মানুষ ভেজালমুক্ত ফল পাবে। এখানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিশুদ্ধ ফল আনা হয়েছে। এ ছাড়া যেসব ফল অপ্রচলিত বা বিলুপ্তির পথে, তা–ও দেখার সুযোগ হচ্ছে মেলায়।