করোনা কোনো মহামারি নয়, রোগও নয়, এটা হচ্ছে কাফির–মুশরিক ও তাদের গোলামদের প্রতি কাট্টা কঠিন মহাগজব। মুসলমানদের কখনো করোনা হবে না। তাই মাস্ক পরাও কুফরি ও শিরকি—এই ফতোয়া দিয়েছেন রাজারবাগ দরবার শরিফের পরিচালক কথিত পীর দিল্লুর রহমান। বছরের পর বছর রাষ্ট্রীয় নীতি ও সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে নিয়মিত এমন নানা ফতোয়া দিয়ে আসছেন তিনি।
কথিত এই পীরকে নিয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) রোববার হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। বলা হয়েছে, দৈনিক আল ইহসান ও মাসিক আল বাইয়্যিনাত নামের দুটি পত্রিকা ও প্রচারপত্রকে মগজধোলাইয়ের কাজে ব্যবহার করছে দরবার শরিফ।
দেশের ৬টি জেলায় পৃথক ৩৪টি মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ এনে রাজারবাগের পীর ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা চেয়ে আট ব্যক্তি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলেন। এর বাইরে আরও একটি রিট করেছিলেন ৪৯ মামলায় জর্জরিত একরামুল হাসান নামের এক ব্যক্তি। প্রথম রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সিটিটিসির প্রতি হাইকোর্ট নির্দেশনা দেন, ‘উক্ত পীর (রাজারবাগের কথিত পীর দিল্লুর রহমান) এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় “উলামা আঞ্জুমান আল বাইয়্যিনাত” অথবা ভিন্ন কোনো নামে কোনো জঙ্গি সংগঠন আছে কি না’ তা তদন্ত করে দেখার। ওই নির্দেশনা অনুসারে সিটিটিসি রোববার তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।
এ বিষয়ে দৈনিক আল ইহসান ও মাসিক আল বাইয়্যিনাতের সম্পাদক মুহম্মদ মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্তকারী কর্মকর্তা বুঝতে পারেননি। তাই এসব কথা বলছেন।’ তিনি আরও বলেন, তাঁরা জামায়াত ও জঙ্গিবাদবিরোধী। ফতোয়াও দেন না।
জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার বিষয়টি খতিয়ে দেখেন সিটিটিসির সহকারী পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম। আদালতে জমা দেওয়া ওই প্রতিবেদন নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কোনো কথা বলতে চাননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই কর্মকর্তা রাজারবাগ দরবার শরিফে গিয়ে বিভিন্ন শিরোনামে লেখা ৪৮টি বই, দৈনিক আল ইহসান ও আল বাইয়্যিনাতের বিভিন্ন সংখ্যা পর্যালোচনা করেন। কবে কোথায় দরবার শরিফ থেকে কী ফতোয়া দেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে তিনি আদালতে তথ্য–প্রমাণ জমা দিয়েছেন। দিল্লুর রহমান ও তাঁর সহযোগীদের সঙ্গেও কথা বলেছে সিটিটিসি।
যে যে বিষয়ে ফতোয়া
রাজারবাগ দরবার শরিফ থেকে কী কী ফতোয়া দেওয়া হয়েছে, তার সবিস্তার সিটিটিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। তারা সাম্প্রদায়িক উসকানি ও রাষ্ট্রীয় নীতিবিরোধী বক্তব্য হরহামেশাই দিয়ে আসছে বলে প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। তারা হত্যা ও মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশনা দিয়ে নিয়মিত ফতোয়া দিয়ে থাকে।
তাদের অবস্থান বাল্যবিবাহের পক্ষে। ইসলাম ধর্মে বাল্যবিবাহের পক্ষে কোনো নির্দেশনা নেই, এমন কথা উল্লেখ করেছে তারাই। তারপরও বলেছে, ‘মেয়েদের বালেগা হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স সাধারণভাবে ৯ বছর, ছেলেদের বালেগ হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স সাধারণত ১২ বছর। কাফির, মুশরিক ও মোনাফিকরা মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়স নির্ধারণ করেছে ১৮ বছর আর ছেলেদের ক্ষেত্রে নির্ধারণ করেছে ২১ বছর। তারা প্রচার করে যে ১৮ বছরের নিচে মেয়েরা শিশু, ২১ বছরের নিচে ছেলেরা শিশু। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বলা যাবে না। বললে ঈমান নষ্ট হবে।’
রাজারবাগ দরবার শরিফ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাবিরোধী। তারা বলেছে, ‘ইসলামের নামে গণতন্ত্র করা হারাম, হরতাল করা হারাম, লংমার্চ করা হারাম, ব্লাসফেমি আইন চাওয়া হারাম, কুশপুত্তলিকা দাহ করা হারাম।’ এ ছাড়া পয়লা বৈশাখ, থার্টিফার্স্ট নাইট, ভ্যালেন্টাইনস ডে ইত্যাদি যারা পালন করবে, তারা জাহান্নামে যাবে বলেও একাধিক ফতোয়া দিয়েছে।
বেশ কিছু জেলার নাম পরিবর্তনের পক্ষে প্রচার
রাজারবাগ দরবার শরিফ থেকে বেশ কিছু জেলার নাম পরিবর্তনের পক্ষে প্রচার চালানো হচ্ছে বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। হাইকোর্টে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে ছক আকারে তার উল্লেখ করেছে সিটিটিসি। যেমন তারা নরসিংদীকে নূরসিবাদ বা নূরানীবাদ, নারায়ণগঞ্জকে নূরানীগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে আমানবাড়িয়া, ময়মনসিংহকে মুমিনশাহী, ঠাকুরগাঁওকে নূরগাঁও, লক্ষ্মীপুরকে নূরপূর ও গোপালগঞ্জকে গোলাপগঞ্জ করার পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কথিত পীর দিল্লুর রহমানের মুরিদ ও একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জেলার নাম গোলাপগঞ্জ লিখে কার্ডও ছাপিয়েছেন বলে জানতে পেরেছেন তাঁরা।
লিখিত জবানবন্দি দিতে রাজি হননি দিল্লুর রহমান
সিটিটিসির কর্মকর্তারা রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমান ও তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। দিল্লুর রহমান বলেছেন, আউটার সার্কুলার রোড, রাজারবাগে ৪৫ কাঠা জমির ওপর স্বাধীনতার পর থেকে মসজিদ, মাদ্রাসা, মার্কেট নির্মাণ করে তিনি ও তাঁর ভাইবোনেরা ভোগ করে আসছেন। তাঁদের প্রকাশিত মাসিক আল বাইয়্যিনাত ও দৈনিক আল ইহসান পত্রিকা, ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারের মাধ্যমে জঙ্গিবাদকে নিরুৎসাহিত করা হয়। তাঁদের অজান্তে কেউ যদি জঙ্গিবাদী কোনো অপরাধ করেন বা নাম ভাঙিয়ে কোনো অপকর্ম করেন, তার দায় ব্যক্তির। দিল্লুর রহমান আরও দাবি করেন, তিনি কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলা–মোকদ্দমা করেননি।
অন্যদিকে মুহম্মদ মাহবুব আলম পুলিশকে জানান, ১৯৮৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে রাজারবাগের পীর দেশের ৬৪ জেলায় অসংখ্যবার ওয়াজ মাহফিল করেছেন। ১৯৮৬ সালে মসজিদে নববীর আদলে মাটি ও খেজুরগাছ দিয়ে সুন্নতি মসজিদ তৈরির পর দরবারে লোকের আসা–যাওয়া ও মুরিদের সংখ্যা বাড়ে। সারা দেশে রাজারবাগের পীরের এক কোটি মুরিদ আছে। ‘জিন ও রেজালুল গায়েব’সহ (জনমানবহীন প্রান্তরে থাকা রহস্যময় মানব) এই সংখ্যা আরও বেশি। তাদের সাতটি প্রতিষ্ঠান ও দেশব্যাপী অনেক খানকা–মাদ্রাসা আছে।
পুলিশ রাজারবাগ দরবার শরিফ পরিচালিত ৭৩টি খানকা ও মাদ্রাসার খোঁজ পেয়েছে। হাইকোর্টে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে তারা বলেছে, সারা দেশে অসংখ্য খানকা, মাদ্রাসা, মসজিদসহ নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে দরবারের অনুসারী করার চেষ্টা করা হয় ধর্মপ্রাণ মানুষকে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার যে অভিযোগ উঠেছে, তার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।