মশককর্মী, নিরাপত্তাপ্রহরী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও ‘চালক’

দক্ষিণ সিটিতে ময়লাবাহী গাড়ি ৩১৭টি। চালক ৮৬ জন। উত্তর সিটিতে ময়লাবাহী গাড়ি ১৬৫টি। চালক ৮২ জন।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী ভারী গাড়ি চালাচ্ছেন নিরাপত্তাপ্রহরী, অফিস সহায়ক, মশককর্মী, সুইসম্যান ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। তাঁরা নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে ভারী যানবাহন চালাচ্ছেন। তাঁদের বেশির ভাগেরই ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স নেই। বছরের পর বছর এমন কাণ্ড ঘটে চললেও সিটি করপোরেশন জেনেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ময়লা পরিবহন করা ভারী যানবাহন (৬ চাকা থেকে ১০ চাকার গাড়ি) রয়েছে ৪৮২টি। এর মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ি রয়েছে ১৬৫টি। বিপরীতে স্থায়ী চালক আছেন মাত্র ৬২ জন। এর বাইরে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া চালক আছেন ২০ জন।

অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ময়লাবাহী গাড়ি ৩১৭টি। বিপরীতে চালক ৮৬ জন। চালকের চেয়ে গাড়ির সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি হওয়ায় দক্ষিণ সিটির নিরাপত্তাপ্রহরী, মশককর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া শ্রমিকদের দিয়েও গাড়ি চালানো হয়।

এর বাইরে দুই সিটিতেই স্থায়ী বা অস্থায়ী কর্মী নন, এমন অসংখ্য বহিরাগত লোকদের দিয়ে ময়লাবাহী গাড়ি চালানো হচ্ছে, যাঁদের ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স নেই। অদক্ষ ও সিটি করপোরেশনের বাইরের লোকদের দিয়ে ভারী গাড়ি চালানোয় সড়কে প্রায়ই বারবার ঘটছে দুর্ঘটনা।

এর মধ্যে গত বুধবার দুপুরে গুলিস্তান এলাকায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান নিহত হন। পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে বসুন্ধরা শপিং সেন্টারের বিপরীত পাশে উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন প্রথম আলোর সাবেক কর্মী আহসান কবীর খান। দুটি ঘটনাতেই সিটি করপোরেশনের গাড়ির চালকের আসনে যে দুজন ছিলেন, তাঁরা কেউ দুই সিটির নিয়োগপ্রাপ্ত স্থায়ী চালক নন। দক্ষিণ সিটির ময়লাবাহী গাড়িটির চালক ছিলেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। আর উত্তর সিটির গাড়িটি চালাচ্ছিলেন ‘বহিরাগত’ একজন চালক, যাঁদের ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স নেই।

ওই দুজনসহ এ বছর এখন পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় ছয়জন নিহত হওয়ার তথ্য জানা গেছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে রাজধানীর গেন্ডারিয়ার দয়াগঞ্জ মোড়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) টেলিফোন বিভাগের কর্মী খালিদ। গত এপ্রিল মাসে যাত্রাবাড়ীর বিবির বাগিচায় দক্ষিণ সিটির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন এক রিকশাচালক। তখন ক্ষুব্ধ লোকজন ময়লার গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া গত মে মাসে শাহজাহানপুর এলাকায় ময়লার গাড়ির চাপায় একজন এবং ৯ আগস্ট শ্যামপুরের দোলাইরপাড় এলাকায় তৈরি পোশাক কারখানার এক কর্মী নিহত হন।

তাঁরাও চালক

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ময়লাবাহী গাড়ির বাইরেও কর্মকর্তাদের গাড়ি চালান পরিচ্ছন্নতাকর্মী, মশককর্মী ও নিরাপত্তাপ্রহরীরাও। দক্ষিণ সিটির একটি সূত্র জানিয়েছে, সংস্থার সচিব আকরামুজ্জামানের গাড়ি চালান নিরাপত্তাপ্রহরী হিসেবে চাকরি পাওয়া মো. মুহিদুল। অবিভক্ত ঢাকা সিটির সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সময় মুহিদুলের চাকরি হয়েছিল নিরাপত্তাপ্রহরী হিসেবে। এ ছাড়া দক্ষিণ সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিনের গাড়ি চালান পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া আল আমিন।

উত্তর সিটির মেয়রের বহরে (প্রটোকল) থাকা ০১৪৮ নম্বরের গাড়িটি চালান বিদ্যুৎ বিভাগের সুইসম্যান খলিলুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সুইসম্যান পদে চাকরি হলেও এক বছর আগে চালক হিসেবে তাঁর বদলি হয়েছে।

ময়লার গাড়ি চলে ‘বদলি চালকে’

দুই সিটি করপোরেশনের একাধিক সূত্র বলছে, স্থায়ী নিয়োগ পাওয়া যেসব চালকের অনুকূলে ভারী যানবাহন বরাদ্দ আছে, তাঁদের বেশির ভাগই নিজেরা গাড়ি চালান না। তাঁদের নামে বরাদ্দ থাকা গাড়ি চালাচ্ছেন অন্যরা।

গত বৃহস্পতিবার মিরপুরের দিয়াবাড়ীতে উত্তর সিটির বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্রে (এসটিএস) গিয়ে দেখা যায়, বর্জ্য নিতে সেখানে গাড়ি (পরী-১০২০) নিয়ে এসেছেন আলাউদ্দিন নামের এক চালক। তবে করপোরেশনের নথিতে এই গাড়ির বরাদ্দ উত্তর সিটির পরিবহন চালক ইউনিয়নের সভাপতি আলী আকবরের নামে। আলাউদ্দিন করপোরেশনের দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করা একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী।

নিজে গাড়ি না চালিয়ে অন্যকে দিয়ে গাড়ি চালানোর বিষয়ে আলী আকবর গতকাল শুক্রবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সেদিন অন্য একটি কাজে গিয়েছেন। একটি ট্রিপের জন্য আলাউদ্দিনকে সেখানে পাঠান।

তবে প্রথম আলোর সূত্র বলছে, আলী আকবরের মতো দুই সিটির পরিবহন ইউনিয়ন নেতারা কেউ গাড়ি চালান না। তাঁরা করপোরেশনের বিভিন্ন দপ্তরে ‘তদবির বাণিজ্য’ করেন।

নাম না প্রকাশের শর্তে দুই সিটির পরিবহন বিভাগের দুজন কর্মকর্তা ও তিনজন কর্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, চালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা নেতা, তাঁদের আসলে গাড়ি চালাতে হয় না। অন্যদের দিয়ে তাঁরা গাড়ি চালান। দক্ষিণ সিটিতে এই প্রবণতা খুব বেশি। এর মধ্যে কেউ কেউ কয়েক বছর ধরে নিজের নামে বরাদ্দ করা ময়লাবাহী গাড়ি চালাচ্ছেন না।

দক্ষিণ সিটির পরিবহন শাখার মহাব্যবস্থাপক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, চালকসংকটের কারণে মশক এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মধ্যে যাঁদের লাইসেন্স আছে, তাঁদের দিয়ে ময়লাবাহী গাড়ি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। কর্তৃপক্ষ এভাবে গাড়ি চালানোর অনুমোদন দিয়েছে।

ভারী গাড়িতে হালকা যানের চালক

উত্তর সিটির যান্ত্রিক বিভাগের পরী-১০২৬ নম্বর ময়লাবাহী গাড়ির চালক মো. নুর ইসলাম। তাঁর সঙ্গে চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন ছেলে মো. উজ্জ্বল। উজ্জ্বল এখন বর্জ্যের যান্ত্রিক বিভাগের ময়লাবাহী একটি গাড়ি চালান।

উজ্জ্বল প্রথম আলোকে জানান, এক বছর আগে তাঁর নামে গাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্স হালকা যানের। তবে ভারী যানের লাইসেন্স পেতে আবেদন করেছেন।

উত্তর সিটির ময়লাবাহী পরী-১০৪০ নম্বরের ভারী গাড়িটি চালান আজম আলী খান। তাঁরও লাইসেন্স হালকা যানের।

নিজেরা না চালিয়ে কীভাবে অন্যদের দিয়ে ভারী গাড়ি চালানো হচ্ছে, এ বিষয়ে দুই সিটির একাধিক সূত্র বলেছে, স্থায়ী একজন চালক মূল বেতনের বাইরে প্রতি মাসেই ওভারটাইম হিসেবে অতিরিক্ত টাকা পান। এর বাইরে গাড়ির জন্য বরাদ্দ করা জ্বালানি তেল নিয়েও নয়ছয় রয়েছে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন থেকে আয়ের নানা পথ তাঁদের রয়েছে। এসব টাকা থেকে বহিরাগত বা অন্য যাঁদের দিয়ে গাড়ি চালানো হয়, তাঁদের জনপ্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

বহিরাগত লোকদের দিয়ে গাড়ি চালানো, চালক না হয়েও অন্য পদে থাকা লোকদের দিয়ে গাড়ি চালানোর বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব অনিয়মে যাঁরা জড়িত, তাঁদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিটি করপোরেশনে চালকসংকট প্রকট। এ জন্য ৯০ জন চালক নিয়োগের অনুমতি পেতে মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পরই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। গত সপ্তাহে ৪৫ জন (ভারী যানের চালক) নিয়োগের অনুমতি পাওয়া গেছে।’

অন্যদিকে দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের বরাত দিয়ে সংস্থাটির মুখপাত্র মো. আবু নাছের প্রথম আলোকে বলেন, নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গঠিত তদন্ত কমিটি এসব অনিয়ম, অবহেলা ও গাফিলতি খতিয়ে দেখবে। তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অব্যবস্থাপনা বন্ধে দরকার কঠোর শাস্তি

সিটি করপোরেশনের গাড়ি যার–তার হাতে তুলে দেওয়ার সঙ্গে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহন পরিচালনার বিষয়টি যে দুই সিটির নিয়ন্ত্রণে নেই, এটা তো স্পষ্ট। অদক্ষ চালকের হাতে গাড়ি তুলে দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখানোয় দুই সিটির পরিবহন মহাব্যবস্থাপকের এই মুহূর্তেই পদত্যাগ করা উচিত।