বর্জ্য অপসারণের পর পানির প্রবাহ দেখা যাচ্ছে। রাজধানীর ইব্রাহিমপুর বাজার রোডের পুলপাড় এলাকায়। গত শুক্রবার দুপুরে
বর্জ্য অপসারণের পর পানির প্রবাহ দেখা যাচ্ছে। রাজধানীর ইব্রাহিমপুর বাজার রোডের পুলপাড় এলাকায়। গত শুক্রবার দুপুরে

মরা খালে ‘প্রাণ’ ফিরছে

উত্তর সিটি ১৪ খালে এবং দক্ষিণ সিটি ৫ খাল ও ২ বক্স কালভার্ট থেকে বর্জ্য অপসারণের কাজ করছে।

দুই মাস আগেও নাক চেপে রাজধানীর ইব্রাহিমপুর খাল এলাকা পার হতে হতো। চারদিকে উৎকট গন্ধের কারণে খালপাড়ের বাসিন্দাদের জীবনও ছিল দুর্বিষহ। ধীরে ধীরে সে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। দখল–দূষণ তো ছিলই, সঙ্গে নানা ধরনের আবর্জনা জমে খালের প্রস্থ কমে তা সরু নালায় রূপ নিয়েছিল। কিছু এলাকায় আবর্জনা এমনভাবে জমে ছিল যে সেখানে খাল আছে কি না, সেটিও বোঝার উপায় ছিল না। সে জায়গাতেই এখন পানির প্রবাহ দেখা যাচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটির অধীন ইব্রাহিমপুর ও কাফরুল এলাকার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই খালের দৈর্ঘ্য প্রায় সোয়া এক কিলোমিটার। কাগজে–কলমে এর প্রস্থ কোথাও ৯ ফুট কোথাও ১৮ ফুট। গত জানুয়ারিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ অভিযান চালানোর আগে খালের প্রস্থ কোথাও ছিল ৫ ফুট কোথাও ১০ ফুট। উচ্ছেদের পর খাল আগের অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। এই খাল থেকে ৮৫০ টন বর্জ্য ইতিমধ্যে অপসারণ করা হয়েছে।

কাফরুলের স্থানীয় বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে অভিযান শুরুর পর এখন মরা খালে পানির প্রবাহ দেখা যাচ্ছে। তবে খালের জায়গায় দখল করে তৈরি করা অনেক স্থাপনা এখনো উচ্ছেদ হয়নি। ছোট দখলদারদের পাশাপাশি বড় দখলদারদের উচ্ছেদ করতে না পারলে এই কার্যক্রম শেষ পর্যন্ত সফল হবে না।

ইব্রাহিমপুর খালের মতো আরও ১৪টি খাল থেকে বর্জ্য অপসারণের পাশাপাশি দখলদারদের উচ্ছেদে কাজ করছে উত্তর সিটি করপোরেশন। একইভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও পাঁচটি খাল ও দুটি বক্স কালভার্ট পরিষ্কার ও দখলমুক্ত করার কার্যক্রম চালাচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ বলছে, ইব্রাহিমপুর খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, গোদাগারি খাল, রূপনগর খাল, সাগুফতা খালসহ ১৪টি খাল থেকে গত দেড় মাসে ৯ হাজার ৩০০ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। আগামী বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে পরিকল্পনামাফিক কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা।

খাল উদ্ধার ও পরিষ্কার কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন জানিয়ে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, খাল পরিষ্কার কার্যক্রমটি তাঁদের অগ্রাধিকারে থাকা কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাঁর দাবি, যেভাবে কাজটি করা হচ্ছে তাতে কিছুদিনের মধ্যে মোহাম্মদপুর এলাকার রামচন্দ্রপুর খাল ও মিরপুর এলাকায় রূপনগর খালে নৌকা চালানো যাবে।

* ১৪টি খাল থেকে দেড় মাসে ৯ হাজার ৩০০ টন বর্জ্য অপসারণ করেছে উত্তর সিটি। * দক্ষিণ সিটি ৫ খাল ও ২ বক্স কালভার্ট থেকে ২১ হাজার ৪৭ টন বর্জ্য অপসারণ করেছে।

আগে ঢাকার ২৬টি খাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার কাছে ছিল। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর এসব খালের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনের অংশ হিসেবে খাল ও নালা পরিষ্কার ও দখলমুক্ত করতে টানা অভিযান পরিচালনা করছে দুই সিটি করপোরেশন।

ঢাকায় খালের সংখ্যা কত, এ নিয়েও নানা মত রয়েছে। নদী নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের ২০২০ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় ৭৩টি খাল রয়েছে। তবে ২০১৬ সালে করা ঢাকা জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী খালের সংখ্যা ৫৮টি। তখন জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এসব খালের মধ্যে ৩৭টি খালেই দখলদার রয়েছে। ফলে এসব খাল স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়েছে। আর বাকি সব কটি খালের জায়গায় রাস্তা হয়েছে।

এদিকে উত্তর সিটির মতো দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও খাল দখলমুক্ত ও বর্জ্য অপসারণে অভিযান চালাচ্ছে।

১৩ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ সিটির আওতাধীন জিরানী খাল পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, খননকাজ প্রায় শেষের দিকে। এখন পর্যন্ত খাল থেকে
৫৫ হাজার টন মাটি অপসারণ করা হয়েছে। আর বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে প্রায় দেড় হাজার টন। খালের বেশির ভাগ অংশে পানিপ্রবাহ দৃশ্যমান। খালসংলগ্ন ত্রিমোহিনী বাজারের দোকানি রাসেল সরকার প্রথম আলোকে বলেন, গত ১০ বছরের মধ্যে এই প্রথম খাল পরিষ্কার করতে দেখেছেন তিনি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ বলছে, জিরানী খাল, মান্ডা খাল, শ্যামপুর খাল, কদমতলা খাল, কমলাপুর খালসহ দুটি বক্স কালভার্ট থেকে গত দেড় মাসে সব মিলিয়ে ২১ হাজার ৪৭ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে।

দক্ষিণ সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সফিউল্লাহ সিদ্দিক ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচটি খাল ও বক্স কালভার্টের জমে থাকা বর্জ্য ও মাটি ৭০ থেকে ৮০ ভাগ অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে। মরা খালগুলো বর্ষার আগেই সচল করতে চান তাঁরা।

দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, খাল দখলমুক্ত ও বর্জ্য অপসারণের কাজে গত দেড় মাসে খরচ হয়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত নিজস্ব তহবিল থেকে এই টাকা খরচ করেছে দুই সিটি। খাল ও নালার রক্ষণাবেক্ষণে সরকারের কাছে ২৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে উত্তর সিটি প্রাথমিকভাবে চেয়েছে ৬১ কোটি টাকা। আগে খাল রক্ষণাবেক্ষণে ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব কোনো বরাদ্দ ছিল না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে এই খাতে বছরে ৪০ থেকে ৬০ কোটি টাকা পেত ওয়াসা।

খাল উদ্ধারে দুই সিটির চলমান কার্যক্রম নিয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াসার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর বসে না থেকে দেড় মাসে যতটুকু কাজ হয়েছে, সেটি মন্দ নয়। বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে এটি জরুরি ছিল। খালে পানিপ্রবাহ ফিরে আসায় এই বর্ষায় কিছুটা হলেও সুফল পাওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, খালগুলো উদ্ধারের পর তদারকি না করলে ওয়াসা যেটা করেছে, সেটার পুনরাবৃত্তি হবে। খাল উদ্ধারের পাশাপাশি এর দুই পাড় সংরক্ষণের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা না থাকলে এবারের উদ্যোগও কাজে আসবে না।