বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ
বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস

বিমানে অব্যবস্থাপনা, দায় চাপাচ্ছে পাইলটদের ওপর

পাইলটদের বেতন-ভাতা কর্তন, কৃত্রিম সংকট তৈরি ও অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা উড্ডয়ন করানোসহ নানা অব্যবস্থাপনা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে পাইলটদের নিয়ে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে। করোনা মহামারির মধ্যে পাইলটদের বেতন-ভাতা কর্তন, কৃত্রিম সংকট তৈরি ও অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা উড্ডয়ন করানোসহ নানা অব্যবস্থাপনা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আমি অক্টোবর ও নভেম্বর—এ দুই মাসের প্রতি মাসেই কর্মঘণ্টার চেয়ে অতিরিক্ত ১৫ ঘণ্টা ফ্লাই করেছি। আমি বাপার নির্বাহী কমিটির পরামর্শে পাইলটদের ন্যায্য দাবি নিয়ে কথা বলেছি। আমার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে। একটা নিরপেক্ষ তদন্ত করে বিষয়টি খতিয়ে দেখার দাবি জানাই
জ্যেষ্ঠ পাইলট ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান

অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন সমন্বয় করা হলেও পাইলটদের বেতন-ভাতার বিষয়টি পুরোপুরি সমন্বয় না করে উল্টো পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এ নিয়ে পাইলটদের মধ্যে নতুন করে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পাইলট অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) সূত্র জানায়, এর মধ্যে বেতন-ভাতা পুরোপুরি সমন্বয়ের দাবিতে নির্ধারিত কর্মঘণ্টার বাইরে ফ্লাইট না চালানোর কর্মসূচিও নিয়েছিলেন পাইলটরা। এর জেরে গত ২৯ নভেম্বর বাপার সভাপতি মাহবুবুর রহমানকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

পাইলটরা বলছেন, করোনাকালে তাঁদের প্রশিক্ষণ বন্ধ ছিল। করোনার অজুহাতে ১৫ জন পাইলটকে বিনা বেতনে ছুটিতে রাখা হয়েছে। ৫৬ জন পাইলটকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পাইলটদের চাপে ফেলা হয়েছে। ক্ষুব্ধ পাইলটরা নির্ধারিত কর্মঘণ্টার বেশি দায়িত্ব পালন করতে চাচ্ছেন না।

জ্যেষ্ঠ পাইলট ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিমান কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকার নোটিশ বা শোকজ না দিয়েই তাঁকে চাকরিচ্যুত করেছে, যাতে বিমানের চাকরিবিধি ও শ্রম আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি অক্টোবর ও নভেম্বর—এ দুই মাসের প্রতি মাসেই কর্মঘণ্টার চেয়ে অতিরিক্ত ১৫ ঘণ্টা ফ্লাই করেছি। আমি বাপার নির্বাহী কমিটির পরামর্শে পাইলটদের ন্যায্য দাবি নিয়ে কথা বলেছি। আমার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে। একটা নিরপেক্ষ তদন্ত করে বিষয়টি খতিয়ে দেখার দাবি জানাই।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, করোনা পরিস্থিতিতে গত বছরের ৫ মে এক প্রশাসনিক আদেশে বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পাইলটদের বেতন কমানো হয়। এর মধ্যে পাইলটদের বেতন কমানো হয় ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। বন্ধ হয় ওভারসিস অ্যালাউন্স, যা স্থায়ী বেতনের অংশ। ফলে মোট বেতন কমার হার দাঁড়িয়েছিল ৫৭ থেকে ৬৫ শতাংশ। এ ছাড়া বন্ধ হয় ওভারটাইম, প্রোডাক্টিভিটি অ্যালাউন্স ও ফ্লাইং অ্যালাউন্স। এরপর চলতি বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহে বিমান বেতন কর্তনের হার ১০ শতাংশ কমিয়ে আনে।

এরপর গত ১৩ জুলাই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জারি করা এক আদেশে বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন কর্তন সমন্বয় করে আগের নিয়মে বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। তবে পাইলটের বেতন-ভাতা কর্তন অব্যাহত থাকে।

বাপার সদস্যরা বলছেন, তাঁদের মোট বেতনের ৪৮ শতাংশ সমন্বয় করা বাকি। গত তিন মাসে বিমানের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন সমন্বয় করা হয়েছে, কিন্তু পাইলটদের বেতনের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে অসন্তুষ্ট পাইলটরা গত ২৫ অক্টোবর থেকে তাঁদের চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত কর্মঘণ্টার বাইরে কাজ করা থেকে বিরত থাকেন। তাতে বিমানের বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বিলম্বিত হয়, দুর্ভোগে পড়েন আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের যাত্রীরা। সে সময় বিমান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাপার নেতাদের দফায় দফায় আলোচনা হয়। সে সময় বিমানের পর্ষদ সভায় বেতন কাটার বিষয়টি সমন্বয় করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়। বিষয়টির এখনো সমাধান হয়নি।

পাইলটরা বলছেন, করোনাকালে তাঁদের প্রশিক্ষণ বন্ধ ছিল। করোনার অজুহাতে ১৫ জন পাইলটকে বিনা বেতনে ছুটিতে রাখা হয়েছে। ৫৬ জন পাইলটকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পাইলটদের চাপে ফেলা হয়েছে। ক্ষুব্ধ পাইলটরা নির্ধারিত কর্মঘণ্টার বেশি দায়িত্ব পালন করতে চাচ্ছেন না। চুক্তি অনুযায়ী তাঁদের মাসে নির্ধারিত কর্মঘণ্টা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ৬০ ঘণ্টা ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ৭৫ ঘণ্টা। এই অবস্থায় ফ্লাইট পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। কয়েক দফা ফ্লাইটসূচি বিপর্যস্ত হয়েছে।

বিমান সূত্র জানায়, গত ২৪ নভেম্বর বিমানের পরিচালনা পর্ষদ সভায় বিমান পরিচালনায় ‘বাধা সৃষ্টিকারী’ পাইলটদের বিষয়ে ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণপূর্বক চাকরি থেকে অপসারণ, অবসায়ন ও বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের’ জন্য বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ক্ষমতা দেওয়া হয়। এর চার দিন পর ২৯ নভেম্বর ক্যাপ্টেন মাহবুবকে চাকরিচ্যুত করার চিঠিতে সই করেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সালেহ মোস্তফা কামাল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বাপার সভাপতিকে নয়, একজন ক্যাপ্টেনকে চাকরিচ্যুত করেছেন। এর বাইরে তিনি আর কিছু বলতে রাজি হননি।

এদিকে বাপা সূত্র জানিয়েছে, বাপা নির্বাহী কমিটি গত বুধবার বিকেলে এক জরুরি বৈঠক ডাকে। বাপার একটি দল বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানকে কাজে পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের একজন জ্যেষ্ঠ পাইলট প্রথম আলোকে বলেন, বিমান কর্তৃপক্ষ নিজেদের অব্যবস্থাপনা ঢাকতে পাইলটদের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে।