বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের দুটি এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন স্ক্যানার (ইডিএস) যন্ত্র নষ্ট হয়ে আছে। এর মধ্যে একটি দুই বছর ধরে নষ্ট। আরেকটি ইডিএস যন্ত্র দুই থেকে তিন মাস পরপরই নষ্ট হয়ে যায়। ইডিএস যন্ত্র নষ্ট হলেই বিপদে পড়তে হয় ব্যবসায়ী ও কৃষকদের। প্রতিবার নষ্ট হলে মেরামত করতে অন্তত দুই সপ্তাহ সময় লাগে। তাঁরা বলছেন, ১০ মার্চ থেকে বিমানবন্দরে একমাত্র সচল ইডিএস যন্ত্রটি নষ্ট হওয়ায় যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতে কোনো কৃষিপণ্য পাঠানো যাচ্ছে না। অথচ কৃষিপণ্য রপ্তানির বড় বাজারটি যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে ঘিরে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলছে, শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজে দুটি এরিয়া রয়েছে। আরএথ্রি ও নন-আরএথ্রি। এর মধ্যে আরএথ্রি জায়গাটি ইউরোপীয় দেশগুলোতে পণ্য পাঠানোর জন্য। সেখানে আছে চারটি ইডিএস ও দুটি এক্স-রে স্ক্যানার যন্ত্র। এর মধ্যে দুটি ইডিএস এখন বিকল। বাকি দুটি ইডিএস নতুন বসানো হয়েছে গত বছর। তবে যুক্তরাজ্য কর্তৃপক্ষ দ্বারা স্বীকৃত নয় বলে সেগুলো চালু হয়নি। আবার ইউকে অ্যাভিয়েশন রেগুলেশন অনুযায়ী, ইডিএস যন্ত্রে স্ক্যানিং ছাড়া অন্য কোনো যন্ত্রে স্ক্যান করা কৃষিপণ্য দেশটি ঢুকতে দেওয়া হয় না।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানি কার্গো কমপ্লেক্সের একটি ইডিএস স্ক্যানার যন্ত্র নষ্ট হয়েছে। এ কারণে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে অন্যান্য দেশে পণ্য পাঠানো যাচ্ছে। স্ক্যানার যন্ত্রটি মেরামতের জন্য যন্ত্রাংশ প্রয়োজন। যন্ত্রাংশ এলেই আবার সচল হবে।
শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে প্রায়ই স্ক্যানার নষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে দুটি ইডিএস স্ক্যানার নষ্ট হয়। সে সময় কার্গো ভিলেজে ব্যাপক পণ্যজট হয়। সে সময় দীর্ঘায়িত হয় বিমানবন্দরের রপ্তানি প্রক্রিয়া। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দরে আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়ে এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তিনি এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গাফিলতি রয়েছে বলে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে অভিযোগ করেন।
যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষিপণ্য বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হয়ে থাকে। যেসব ব্যবসায়ী ফল ও সবজি রপ্তানি করেন তাঁরা বলছেন, প্রায় সময়ই এই ইডিএস স্ক্যানার যন্ত্র নষ্ট হয় বলে তাঁদের পচনশীল কৃষিপণ্য নিয়ে বিপদে পড়তে হয়। যুক্তরাজ্যে সময়মতো পণ্য পাঠাতে না পেরে হয় পণ্য পচে যায়, নয়তো অনেক কম দামে বিক্রি করে দিতে হয়।
এ-সংক্রান্ত ব্যবসায়ীদের সংগঠন হচ্ছে বাংলাদেশ ফুড ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিএফভিএপিইএ)। সমিতির সদস্যসংখ্যা ২০০। বিএফভিএপিইএর হিসাবে, বাংলাদেশ থেকে দৈনিক ১২০ টন মালামাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যায়। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ যায় যুক্তরাজ্যে। প্রতি কেজি পণ্য পাঠিয়ে তাঁরা গড়ে চার ডলার আয় করেন। এই হিসাবে তাঁদের অনুমান, গত ১২ দিনে তাঁরা ৪৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা মূল্যের কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে পারেননি।
যুক্তরাজ্যে লাউ, চালকুমড়া, পটোল, শিম, পেঁপেসহ বিভিন্ন ফল ও সবজি রপ্তানি করে থাকেন লি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. আবুল হোসাইন। তিনি বলেন, ‘কৃষকের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে বিমানবন্দরে নিয়ে এসেছি ১০ মার্চ। এসে শুনি স্ক্যানার নষ্ট। তাই পণ্য পাঠানো যাবে না। পরে ওই পণ্য বাজারে তিন ভাগের এক ভাগ দামে বিক্রি করে দিয়েছি।’
বিএফভিএপিইএর হিসাবে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা মূল্যের ৮২ হাজার ৫১০ মেট্রিক টন ফল ও সবজি রপ্তানি করা হয়েছে। আর সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ২৯ কোটি টাকা মূল্যের ফল ও সবজি বাংলাদেশ রপ্তানি করা গেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্য স্ক্যানিংয়ের জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) প্রতি কেজিতে ছয় সেন্ট করে চার্জ আদায় করে। আর এই টাকা দিয়েই অনায়াসে নতুন স্ক্যানার যন্ত্র কেনা সম্ভব।
বিএফভিএপিইএ সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বেবিচক এক কেজি পণ্য রপ্তানিতে স্ক্যানিংয়ের জন্য ছয় সেন্ট করে মাশুল নেয়। এক সপ্তাহের মাশুলের পয়সা দিয়ে এ রকম চারটি স্ক্যানার যন্ত্র কেনা যায়। কিন্তু বেবিচক কোনো উদ্যোগই নেয় না। একটি যন্ত্র দুই বছর ধরে নষ্ট। আরেকটি কয়েক দিন পরপর নষ্ট হয়। বাকি দুটি স্থাপন করা হলেও সচল করা হয়নি।
মনসুর আহমেদ বলেন, এভাবে ব্যবসা করা যায় না। যুক্তরাজ্যে মানুষ তো আর অপেক্ষায় থাকবে না। ওই বাজারে ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার পণ্য ঢুকবে। তখন আমাদের কিছুই করার থাকবে না। বেবিচককে চিঠি দিয়েও কোনো লাভ হয়নি।
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, দেশের সব বিমানবন্দরের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা ও সরবরাহ করে থাকে বেবিচকের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড স্টোর ইউনিটের (সেমসু)। বিভিন্ন দপ্তরের চাহিদার ভিত্তিতে সেমসু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনে। বেবিচকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব বিমানবন্দরে কোনো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে সেমসু ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের চিঠি চালাচালিতে সময়ক্ষেপণ হয়।’
এ বিষয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ইডিএস যন্ত্র মেরামতের কাজ চলমান আছে। যন্ত্রাংশ আমদানি করে স্ক্যানার মেরামত করতে আরও দুই সপ্তাহের মতো লাগতে পারে।